প্রখ্যাত দার্শনিক, প্রথিতযশা সাহিত্যিক, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ভাষা সৈনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর ১শ' ১৬ তম জন্মবার্ষিকী  আজ

প্রখ্যাত দার্শনিক, প্রথিতযশা সাহিত্যিক, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ভাষা সৈনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর ১শ' ১৬ তম জন্মবার্ষিকী  আজ

মুহাম্মদ ফয়জুর রাহমান

বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রখ্যত দার্শনিক, প্রথিতযশা সাহিত্যিক, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বায়ান্নর ভাষা সৈনিক এবং উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাবেক জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ -এর ১শ' ১৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। 
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দর ২৫ অক্টোবর (৯ কার্তিক ১৩১৩ বঙ্গাব্দ)  বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান  সুনামগঞ্জ জেলার (তদানিন্তন সুনামগঞ্জ মহকুমা) দুহালিয়া'র জমিদার দেওয়ান মোহাম্মদ আসফ-এর ঔরসে তাঁর জন্ম। মাতা মরহুমা মোসাম্মত রওশন হুসেইন বানু ছিলেন বিখ্যাত মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজার সুযোগ্য কন্যা। 

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর শিক্ষা জীবনের শুরু দুহালিয়া মিডল ইংলিশ (এম,ই,) স্কুলে। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ জুবিলি উচ্চবিদ্যালয়, ঐতিহ্যবাহী এম.সি কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। 
 ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদ চৌধুরী একাডেমি (এম,সি একাডেমি)-এর প্রধান শিক্ষক এবং আজিরিয়া মাদ্রাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট  হিসেবে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। সেইসাথে পৈত্রিক ওয়াকফ সম্পত্তির মোতাওয়াল্লিরও দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষকতা পেশায় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ যখন যোগদান করেন,তখন ভারতবর্ষকে  ব্রিটিশ রাজের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় উত্তাল রাজনীতির হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ যোগ দেন তৎকালীন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগে। দায়িত্বপ্রাপ্ত হন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নির্বাহী কমিটিতে।
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের বন্ধ্যাত্ব ঘোচাতে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ(কেমুসাস) প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। 
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসামের উচ্চ পরিষদে মুসলিম প্রার্থী নির্বাচিত হন। এবছর আসামে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার কর্তৃক বহিরাগতদের উপর জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কংগ্রেস সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে জনমত গঠনের পর আসামের কামরূপ-এ যান দেওয়ান আজরফ। সেখানেও জুলুৃম-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান এবং ১৪৪ ধারা অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এসময় সৌভাগ্যক্রমে পুলিশের গুলি থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে একই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তিনি শিলচরে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। এক মাস ছয় দিন কারাবাস শেষে মাউন্ট ব্যাটেন ঘোষণার পর মুক্তিলাভ করেন। 
বৃহত্তর সিলেট জেলা পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তির প্রশ্নে ১৯৪৭-এর গণভোটের প্রচার-প্রচারণায় দেওয়ান আজরফ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং সিলেটের গ্রাম-গ্রামান্তরে ব্যাপক জনমত গঠনে ঘুরে বেড়ান।

১৯৪৭-এ ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের পরপরই আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি পেশের জন্য কলকাতা যান এবং সীমানা নির্ধারণ কমিশনের কাছে ১৩ খানা স্মারকলিপি পেশ করেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।
কলকাতা থেকে ফিরে এসে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাহমুদ আলীর সাথে দেওয়ান আজরফ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র 'নও বেলাল' প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে দু'জনের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ 'নও বেলাল' ছেড়ে ১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন। 
বায়ান্ন'র মহান ভাষা আন্দোলনে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর মূখ্য ভূমিকা ছিলো। ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ-এর তিনি ছিলেন সভাপতি। 
নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন আজীবন অবিচল। জীবনে কোনো বৈপরীত্য  কখনও তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি।  জমিদার হয়েও জমিদার বিরোধী নানকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।  সেইসাথে নিজের জমিদারীতে দাঁড়িয়ে নানকারদের ভূমিস্বত্ব দান করে মানবতা আদর্শের এক উজ্জ্বল ও বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। 

শিক্ষার উন্নয়ন এবং  সম্প্রসারণে বরেণ্য শিক্ষাবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। সুনামগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনার পর পর্যায়ক্রমে তিনি নরসিংদী কলেজ, বৃহত্তর কুৃমিল্লার মতলব কলেজ এবং রাজধানী ঢাকার আবুজর গিফফারী কলেজে অধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। আবুজর গিফফারী কলেজের  প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রাজধানীর এ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপালও ছিলেন তিনি। 
এছাড়াও,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন অধ্যাপনায় 
ব্যাপৃত থেকে তিনি জ্ঞানের আলো বিতরণে ছিলেন তৎপর। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় ৫৩ বছর নিরন্তর শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ জ্ঞান তাপস এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে,  প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। 
বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের খ্যাতনামা দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জাতীয়,  আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত দার্শনিক কনফারেন্স ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ, দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তব্য উপস্থাপন এবং স্বদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। 
১৯৫৬  খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের সভাপতি কর্তৃক মনোনিত প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের মাদ্রাজস্থ আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় দার্শনিক কংগ্রেসেে যোগদান করেন। 
পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-পাক কালচারাল কনফারেন্সে যোগ দেন তিনি। এ কনফারেন্সে তাঁর উপস্থাপিত প্রবন্ধ 'Education of Morality' ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থে স্থান লাভ করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে জগতে বিখ্যাত দার্শনিক আল-কিন্দি'র  জন্মের সহস্র বার্ষিকীতে যোগ দেন এবং আল-কিন্দি'র দর্শনের উপর প্রবন্ধ পাঠ করেন।

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন,তদানিন্তন ব্রিটিশ শাসকদের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলন- সংগ্রাম,১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ ও সিলেটের ঐতিহাসিক গণভোট, বায়ান্ন'র মহান ভাষা আন্দোলনসহ দেশের রাজনীতি,শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, সাংবাদিকতা এবং মানবিকতার চর্চা এবং উন্নয়নে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ অাজরফ-এর অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে। 

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ দেশ-জাতি এবং মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদান  রেখে গেছেন। এসব মহতি কর্মকান্ডের  স্বীকৃতি স্বরূপ জীবদ্দশায় তিনি দেশে-বিদেশে লাভ করেছেন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা, অগণন সংবর্ধনা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদকসহ সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অসংখ্য সম্মাননা- পদক এবং অপরিসীম মর্যাদা। বেগম খালেদা জিয়ার বিগত সরকারের আমলে দেশ ও জাতির স্বনামধন্য এ কৃতি সন্তানকে 'জাতীয় অধ্যাপক'-এর সম্মানেও ভূষিত করা হয়। 
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার 'শিশু' পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর লেখালেখি তথা সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে। নানা বিষয় ভিত্তিক  ৬০ টি  গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি । এরমধ্যে  জীবদ্দশায়   এ মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের ২৪ টিরও অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হযেছে। পরবর্তীতে বেরিয়েছে আরও কয়েকটি গ্রন্থ। 
জ্ঞান তাপস অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন দেশ ও জাতির জন্য এক 'অনন্য বাতিঘর'। আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে এক আশার আলোকবর্তিকা। 
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর দেশ ও জাতির 'অনন্য বাতিঘর' হিসেবে সুপরিচিত এ জ্ঞান তাপস ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। 
দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও দার্শনিক  দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর ১১৬তম  জন্মবার্ষিকীতে 

পরম করুণাময় রাহমানুর রাহিম মহান স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা পরপারে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদৌসের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ক্ববুল করে নিন-এই প্রার্থনা।