গ্রহণ   ( পর্ব ১১ ) 

গ্রহণ   ( পর্ব ১১ ) 

শামীমা আহমেদ

হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে শাহেদের চারটার মত বেজে গেলো। আজ দীপিকার সাথে এতদিন পর দেখা হবে! ভেতরে কেমন যেন একটা ভাললাগা।

কিছু হারিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ সেটা সামনে এসে গেলে যেমনটা চমক লাগে, তেমনি অনুভুতিতে বারবার পুলকিত হচ্ছে শাহেদ। ফিরতে হয়তো দেরি হতে পারে। শাহেদ তার ল্যাপটপ, লাঞ্চবক্স, ব্যাগ সবকিছু গুছিয়ে রেখে গেল অফিস ডেস্কের লকারে। লাবনীকে ফোন করে জানালো আজ জরুরী একটা কাজ আছে। বাইরে বেরুতে হবে তাই ফিরতে হয়তো দেরী হবে। লাবনী খুব সহজভাবেই তা মেনে নিলো আর বাসার জন্য কী কী আনতে হবে তা বলতে লাগলে, শাহেদ থামিয়ে বললো, একটু মেসেজে দিয়ে রেখো প্লিজ। শায়ানের খেয়াল রেখো। শায়ান তখন ঘুমাচ্ছে তাই আর কথা হলোনা। শাহেদ ওয়াশ রুমে গিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে নিলো। 

বারবার ঘড়িতে তাকাচ্ছে শাহেদ। ঠিক পাঁচ টায় শাহেদের মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠলো। অফিস টাইমে রিং টোন বাজানো নিষেধ আছে। শাহেদ কারো কাছ থেকে তেমন ভাবে বিদায় না নিয়ে শুধু , নতুন জয়েন করা জুনিয়র ছেলে সজলকে চোখের ইশারায় বাই বলে লিফটের সামনে দাঁড়াল। লিফট এলে দ্রুতই ফ্রন্ট ডেস্ক লবিতে নেমে এলো। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা সিলভার কালারের প্রাইভেট কার। চালকের আসনে একজন আধুনিকা নারী। চোখে খুব সুন্দর ফ্রেমের একটা চশমা। 

শাহেদ এগিয়ে যেতেই দীপিকা গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। দুজনই কিছুক্ষন দুজনার দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে রইল। হয়তো দুজন অতীত স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছে।প্রায় দশ বছর পর দেখা হলো।

দীপিকাই বলে উঠলো কেমন আছো শাহেদ?

গাড়িতে এসো। শাহেদ এগিয়ে গেলে দীপিকা দরজা খুলে দিল। দুজনে সামনের সিটে বসল।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করলে দুজনার আলাপচারিতা শুরু হলো।

বছরের পর বছর ধরে দুজনে একই অফিস পাড়ায় তবুও জানা নেই দেখা নেই।আসলে

দীপিকাই নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল।

আর শাহেদও নিজের জীবন গড়তে এতই ব্যস্ত ছিল যে দীপিকাকে খুঁজে নিতে সময় করা হয়নি।।

দীপিকা জানতে চাইলো, শাহেদ এতগুলো বছর হয়ে গেছে আমার কথা কী তোমার কখনো মনে পড়েনি?একটিবারও জানতে ইচ্ছা হয়নি আমি কেমন আছি?

শাহেদ কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। কেমন করে বুঝাবে তুমি আমার জীবনের একটি অতৃপ্ত অধ্যায়। হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া, শুকনো পাতায় ঢেকে রাখা একটি অতি মূল্যবান কনক মোহর।তোমাকে ধরে রাখার জন্য আমার চেস্টার কোন কমতি ছিল না। কিন্তু ভাগ্য আমাদের পক্ষে ছিল না। 

শাহেদ বললো, ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি তাই,,

ভাগ্যের কথা শুনে দীপিকা ক্ষোভে ফেটে পড়লো।

ভাগ্য? যদি ভাগ্যই হবে তবে আমি কেন এত বিত্ত বৈভব আর উন্নত জীবনের সংসার ত্যাগ করেছি।সেটা কেন ভাগ্যে জুড়ে নেইনি।

শাহেদ কিছুই বুঝতে পারছে না দীপিকা কি বলতে চাচ্ছে। ত্যাগ করেছ মানে?

মানে, তুমি বিয়েটা করোনি?

----বাবার সম্মান রাখতে বিয়েটা করেছিলাম কিন্তু আমি লন্ডনে হোস্টেল লাইফে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে এসে ডিভোর্স নিয়েছি।

শাহেদ যেন আকাশ থেকে পড়লো!এ খবরতো তার কানে পৌঁছেনি।

দীপিকা একা একা জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে। আজ সে কোন কথাতেই আর থামছে না। একে একে ওর জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলতে লাগলো।নিজের কষ্টের কথাগুলো দীপিকা শাহেদ ছাড়া আর আজও কারো সাথে শেয়ার করেনি।

শাহেদ এর কিছুই জানে না। জানলে হয়তো দীপিকার সহযোগিতায় এগিয়ে যেতো। দীপিকা সুখেই আছে। এই ভেবে সে নিজেও বিয়ে করে নিল আর লাবনীর মত মেয়ে তার জীবনটাকে এমনভাবে সুখে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছে যে পিছনের কোন কিছুর জন্য আক্ষেপ করার ফুসরতই পায়নি।

কিন্তু দীপিকা আজ যেন সব বলতে চাইছে শাহেদকে। এই একাকীত্বের জীবনে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। দারিদ্রের দুঃখ কষ্টে যেমন সুখ আসেনা তেমনি বিত্ত বৈভবে ডুবে থাকলেও সুখ নাও ধরা দিতে পারে। এখন যেন দুজন দুজনার শুন্যতাটা অনুভব করছে। সেই স্টুডেন্ট লাইফের ভাললাগা আজ এই বয়সে যেন অন্য কিছুর টান অনুভব করছে। একান্তভাবে কাছে না পাওয়ার যে তৃষ্ণা সেটাই যেন অনুভুত হচ্ছে।যদি একজনের প্রতি আরেকজনের আস্থা, বিশ্বাস জন্মে যায় সেটার শিকড় বহুদুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। শত ঝড়েও তা ওপড়াতে পারে না।তাইতো দীপিকার একটু সাড়া পেয়েই শাহেদ যেন ছুটে এলো।

দীপিকা বরাবরই খুব সাহসী মেয়ে। আর ওর বাবার ব্যক্তিত্বের প্রতি ভীষণ দূর্বলতা। প্রতিটি মেয়েই বাবার সেই ব্যক্তিত্ব স্বামীর মাঝে খুঁজে ফিরে।তাইতো মধ্যবিত্ত শাহেদকেই তার ভাল লেগেছিল।

শহরের যানজট এড়িয়ে গাড়ী পূর্বাচলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একটু খোলা যায়গায় নামবে দুজন। শাহেদের পরিপূর্ণ জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করে দীপিকা বললো, তুমিতো দিব্যি বিয়ে সংসার সন্তান নিয়ে সুখের জীবন কাটাচ্ছো আর তোমায় ভেবে আমি আজ একাকীত্বের দিন কাটাই।

শাহেদ দীপিকার একাকীত্বের কষ্টটা অনুভব করলো।

----কেন তুমি আমাকে সব জানাও নি, শাহেদ ভীষণ ভেঙ্গে পড়ছে। এখন নিজের সংসারটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। নিজেকে স্বার্থপর ভাবছে।দীপিকার খোঁজ না নিয়ে এভাবে জীবন সাজানো তার উচিত হয়নি।

দীপিকা গাড়ি পূর্বাচলে একটা খোলা যায়গায় থামালো । এ দিকটা বেশ নির্জন।

দুজনে গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো।শাহেদ আজ মেরুন রঙের শার্ট আর সাথে ক্রীম শেডেড প্যান্ট পরেছে, মিলিয়ে দারুন লাগছে! সুখী পুরুষের সৌন্দর্য তার চোখ মুখ থেকে ঠিকরে 

বেরিয়ে আসে। অবশ্য পুরুষরা এই সুখটাকে বেশীদিন উপভোগ করে না। কিছুদিন গেলেই অসুখী ভাব ফুটিয়ে তোলে আর তখন এরা শুধু নতুনত্ব খোঁজে। দীপিকার কাছে শাহেদকে ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। দীপিকা শাহেদের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। শাহেদ কোন আপত্তি করলো না। নীল কালো শাড়ীতে দীপিকাকে যেন গ্রীক দেবীর মত লাগছে। দীপিকার উচ্চতাটা ওর বাবা থেকে পাওয়া। বাঙালী মেয়েদের উচ্চতা একটা বিরাট ফ্যাক্টর। দুজনে খুব কাছাকাছি।আজ কেউ আর কাউকে দুরে সরাতে চাইছে না।হয়তো যে ইচ্ছে- চাওয়াটা ওদের ভেতরে এতদিন সুপ্ত ছিল আজ ক্ষনিকের তরে হলেও তা পূরণ হউক।দীপিকা শাহেদের হাত ধরলো, খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে এলো। শাহেদের কাঁধে মাথা রাখল।

শাহেদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো না মোটেও। নিজের বর্তমানটিকে পর্দার আড়াল করে নিল। আর এ সময়টাকে অতীতের কাছে সঁপে দিল। সেও খুব শক্ত করে দীপিকাকে কাছে টেনে নিল।দুজনের স্পর্শে এক ভাললাগা অনুভুতি! 

দীপিকা বলেই চলেছে, শাহেদ আমি ক্লান্ত, আমি ভীষণ ক্লান্ত। প্রতিটাক্ষণ আমি তোমাকে অনুভব করি, তোমার সান্নিধ্য খুঁজে ফিরি।হয়তো অতীতে ভালবাসার কোন অনুভুতি আমাদের ছিল না কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমি আমার পাশে 

তোমাকে পেতে চেয়েছি।তোমাকে

একান্তে পাওয়ার জন্য আমি আকুল হয়ে উঠেছি। শাহেদ আমি ভীষণভাবে তোমাকে 

কাছে পেতে চাইছি। তুমি কি মাঝে মাঝে আমার জন্য একটু সময় বের করে দেখা করবে? দীপিকা প্রচন্ড আবেগে কাঁদছে। শাহেদ কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। বারবার তার চোখের সামনে লাবনীর মুখটা ভেসে উঠছে। দীপিকা শাহেদের হাতটি খুব শক্ত করে ধরে আছে। মেয়েদের ভালবাসায় তারা নির্ভরতা খোঁজে। মায়ার বাঁধনে বাঁধে।এতকিছু থাকার পরেও দীপিকা কাঙালের মত শাহেদের একটু সাড়া পাওয়ার অপেক্ষা করছে। এরপর দীপিকা যা বললো শাহেদ একেবারেই তার জন্য প্রস্তুত ছিল না!

---শাহেদ তুমি আমাকে তোমার জীবনে গ্রহণ করে নাও। তোমার বর্তমানকে ভুলে গিয়ে তোমার অতীতকে কাছে টেনে নাও। তোমার অতীত সত্য, ভীষণ ভাবে সত্য। শুধু তোমার জন্য আমি সব দু'পায়ে ঠেলে দিয়েছি। আজ আমার সবদিকে শুন্যতা সেখানে আমি তোমাকে চাইছি। 

দীপিকা ভীষণ ভাবে কাঁদছে। মনে হচ্ছে অনেকদিনের জমানো কান্না। শাহেদ দীপিকাকে খুব কাছে টেনে নিল। দুজন নিঃশ্বাসের দুরত্বে খুব গভীরতায় কাছে এলো। কিচ্ছুক্ষণ ওরা এভাবেই নিশ্চুপ রইল।

চমৎকার সুগন্ধির আবেশে দুজন কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। চলো ফিরতে হবে।শাহেদ দীপিকাকে তাড়া দিলো। দীপিকা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলো। ফেরার পথে দুজনেই নীরবতায় রইল। শাহেদ নীরবতা ভাঙ্গল।আমাকে আমার অফিসে নামিয়ে দিও। আমার গাড়ি থাকবে। দীপিকা আচ্ছা বলে গাড়ীর স্পিড বাড়িয়ে দিলো। হঠাৎ শাহেদ তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো। দীপিকা ভীষণ আশ্চর্য হওয়ার মত দৃষ্টি দিলো! দীপিকা স্টীয়ারিং থেকে বা হাতটা নামিয়ে শাহেদের হাতটা আলতো করে ধরলে শাহেদ শক্ত করে তা নিজের দিকে নিল। দীপিকার হাসিমাখা মুখটিতে শেষ বিকেলের রোদটা এসে পড়েছে। অপূর্ব লাগছে। অতীতে কোনদিন মনযোগ দিয়ে এভাবে দীপিকাকে দেখা হয়নি।

গাড়ি শাহেদের অফিসে এসে থামলে শাহেদ নেমে গেলো। সেদিনের মত বাই জানিয়ে হাত ওয়েভ করে দীপিকার গাড়ি জনারণ্যে মিশে গেলো।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)