চলতে চলতে (ছোট গল্প)

চলতে চলতে (ছোট গল্প)

আবুল খায়ের

চারিদিকে বাঁশির আওয়াজ এবং মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে মাইকে ভেসে আসছে মেলায় আজ নতুন কি কি বই এসেছে। ভালই জমেছে বই মেলা। এই প্রথম বই মেলায় আজগর-সাহেব এর একটি কবিতার বই বের হয়েছে। তাই উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি। ঘুরে ঘুরে বইয়ের দোকানে বিভিন্ন লেখকদের নতুন বইয়ের মলাট উলটিয়ে লেখা। শেখার ও জানার চেষ্টা করা। একজন লেখক হিসেবে নিজেকে নিজের অবস্থান মূল্যায়ন করার চরম সুযোগ কাজে লাগানো।

বাসায় সময় একদম কাটে না। প্রতিদিন বিকেলে মেলায় আসা হয়। আজ মেলার শেষ দিন। কয়েকটি বই কেনা হ’ল। আরো যদি পাওয়া যায় পছন্দ মতো কেনা যেতে পারে। ইতিমধ্যে আজগর সাহেব দু’একজন ভক্ত পাওয়া গেল। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতে বেশ ভালোই লাগছিল।

বইয়ের মলাট দেখতে দেখতে মিলি’র চোখ আটকে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কয়েকদিন সেভ করা হয়নি। খোঁচা খোঁচা গোফ-দাড়ি দেখে তা বোঝা যায়। পেছনে ব্রাশ করা চুল। একদম সাদাসিধে ভদ্রলোক। আড়ংয়ের ফতুয়া গায়ে, একটা চটের ব্যাগ ঝুলানো। মিলি আর একটু এগিয়ে গেল। ছোট ভাই ‘শাফিন’ সাথে আছে। ভাগ্য খুবই খারাপ। এগিয়ে যেতে না যেতেই হাওয়া হয়ে গেল লোকটা। চারিদিকে তাকিয়ে কোন হদিস পাওয়া গেল না। ধ্যাৎ।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। গরু খোঁজার মতো খোঁজা হলো। মন খারাপ করে মেলা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা। মেলার গেটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় একবার শেষ চেষ্টা হিসেবে পিছনে ঘুরে দেখা হল। এমন সময় একদম সামনে পাওয়া গেল আজগর সাহেবকে। নিজের চোখ’কেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রত্যাশিত কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দটা একটু বেশি হয়ে থাকে।

কেমন আছেন ভাই? কোনো কিছু না ভেবে মিলি’র সরাসরি প্রশ্ন। আজগর-ভালো। কিন্তু -----, আপনাকে তো------। জি আমাকে চিনবেন না, মিলি উত্তর দিয়েই আবারও প্রশ্ন-আপনি কি করেন, প্লিজ? আজগর-আমি----, আমি আসলে কিছু করি না। মানে? মিলির প্রশ্ন। সত্যি বলতে কি। আমি একদম বেকার। তবে মাঝে সাজে শখের তাড়নায় কিছু লোখালেখি করার চেষ্টা করি। এইতো আমার একটি বই আসলো মেলায়। গরিবের জীবন। সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু নয়। ও আচ্ছা। তাই বলেন। কবি’দের মতো আমি অত কাব্যিক করে বলতে পারবো না। তবে শুনে খুবই ভালো লাগছে। একজন কবি’র সাথে দেখা করতে পারাও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার-মিলি একটু হেঁসে বলল। কি যে বলেন? আজগর সাহেবের উত্তর।

পাশের স্টলে বসে লেবু চা খেতে খেতে একটু আধটু কথা হলো। সময় নেই। মেলার শেষদিন। প্রচুর বেচাকেনা হচ্ছে বই। কিছুক্ষণ পরেই মেলার স্টল বন্ধ করার হিড়িক শুরু হবে। খুবই ব্যস্ত সবাই। পরে কথা হবে, আজগর সাহেব-বিল পরিশোধ করে বিদায়। কিন্তু মিলি’র তো আর বিদায় বলা কষ্ট হচ্ছে। প্রথম দেখাতেই প্রেম। কোন কার্ড/ফোন নম্বর রাখা হল না। কোথায় থাকে। কি ঠিকানা। কিছুই তো জানা হলো না। কি বোকামিটা না করলাম। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে। বাসায় এসে কোনো কাজ আর ভাল লাগছে না। ভাবতে ভাবতে রাত শেষ।

অনেক চেষ্টা করেও কোনো হদিস পাওয়া গেল না। কয়েকদিন যাবৎ ফেইসবুক গাটাগাটি করে-একই নামে অনেক আজগর পাওয়া গেল। সব তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। কিন্তু যার জন্য এতোসব-তাকে পাওয়া গেল না। বন্ধুদের কয়েকজন’কে বলা হল আজগর নামে কারো কোনো ফেবু বন্ধু আছে কিনা। কিন্তু কী কারণ সেটা কাউকে বলা হল না। ফেইসবুকে বন্ধু না হলেও, বন্ধুর বন্ধু হলেও খোঁজে পাওয়া যায়। যদি বন্ধুর বন্ধুর লিস্টেও না থাকে তবে পাওয়া কষ্ট হয়। মিলি ভাবে, এভাবে আর কতোদিন এভাবে খুঁজে বেড়াবো? কিন্তু অব্যাহত থাকে খোঁজাখুঁজি, যদি সত্যিই সে ফিরে আসে।

একদিন সকালে ঘুম থেকে একটু তাড়াতাড়ি ওঠা হল। নাস্তা-চা খেয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই পত্রিকা দিয়ে গেলো ‘হকার’। পত্রিকার একটি ছবি দেখে মিলি’র বিশ^াস হচ্ছে না। অবশ্য রাতে টিভির খবরে একটি দুর্ঘটনার কথা জানা আছে। বেশ কয়েকটা সড়ক দুর্ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটেছে। কিন্তু আজগর সাহেবের ছবি এইভাবে? নিজেকে কেনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। বার বার পত্রিকার সড়ক দুর্ঘটনার ছবিটা দেখা হল। কিন্তু, না। দেখি নিচে কী লেখা আছে। আর যেন কিছুই ভাবা যাচ্ছে না।

বহুদিন বাড়িতে যাওয়া হয় না। বই মেলা শেষে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছোট ভাই-বোনদের বায়না ছিল। কিন্তু বাংলা একাডেমি’র বই মেলার প্রস্তুতির ব্যস্ততার কারণে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বাড়ি যাওয়ার মজাই আলাদা। মেলার ব্যস্ততা শেষ হলো। সবার সাথে দেখা হবে, তাই বাড়ি ফেরা। ব্যাগে একটি বইয়ের পান্ডুলিপি ছিল-শিরোনাম ‘চলতে চলতে’। উপন্যাস। যেখানে মিলি নামের একটা চরিত্রও ছিল। সম্ভবত আগামী বই মেলার জন্য প্রস্তুত করা। খবরের কাগজে তাইতো লিখল তার একজন বন্ধুর বরাত দিয়ে।

একটি সড়ক দুর্ঘটনা মানে কতগুলো জীবনের অকালে পরিসমাপ্তি। কতগুলো স্বপ্নের গুড়েবালিও বটে। কান্নায় কখন যে বুকটা ভেসে গেল। সেইদিকে কোনো খেয়াল নেই-মিলি’র। খবর পড়ে নিশ্চিত হলো এই সেই আজগর যাকে এতদিন কল্পনার রাজ্যে স্থান দিয়ে লালন করা হচ্ছে সযত্নে । কিন্তু বিধিবাম। জীবনে এই রকম একটা ধাক্কা আসবে কখনও ভাবা হয়নি। মানুষ যা ভাবে না, আর তাই হয়ে যায়। যা কখনও কল্পনাও কওে না অথচ তাই মেনে নিতে হয়। এটাই নিয়তির খেলা। বিড় বিড় করে ভাবছে। এইভাবে চলতে চলতে কোথায় শেষ হবে পথ চলা.....? হঠাৎ ঘনকালো মেঘে আকাশটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। এখনি বৃষ্টি শুরু হবে।

(লেখক: কবি ও কথা সাহিত্যিক)