পিতা এখন ক্লান্ত

পিতা এখন ক্লান্ত

পিতা এখন ক্লান্ত 
শাবলু শাহাবউদ্দিন 

মনে হলো দুচোখ দিয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন হল। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম; জীর্ণ শীর্ণ অর্ধ-ময়লা একটা গামছা মুখের উপর দিয়ে চালিয়ে দিলেন আপন মনে । গরিবের দুঃখ বারবার এভাবে বিলীন হয় ময়লা মাখা গামছাগুলোতে । গামছা যেন গরিব পিতার দুঃখ মোচনের একমাত্র সাথি । এ যেন দুঃখের প্রতিকৃতি ছবি । যে ছবি একজন সত্যিকারের সঠিক বৈধ হালাল খাদ্য ভক্ষণকারি ছাড়া আর কারো চোখে পড়ে না। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রীর কথা বলি, তিনি কোন কালেও এই দৃশ্য দেখতে পাবেন না । কারণ তাদের চোখে রৌদ্র নিবারণ চশমা থাকে । তারা বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ বলে চালিয়ে দেন । সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে বলতে আমার কোন দ্বিধা থাকবে না যে, তারা আসলে স্বয়ং সম্পূর্ণের মানে কী তা জানে কী না । থাক এটা, স্বয়ং ঈশ্বর বিচার করিবে ।


কাল বুধবার, একটি ছোঁয়াচে রোগের জন্য সরকার সারা দেশ জুড়ে  অবরোধের ডাক দিয়েছে;  রোগটি বড্ড পাঁজি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন আক্রান্ত করে রেখেছে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বুঝি এই রোগ বেশি ছড়ায় বলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন বন্ধ । ছোঁয়াচ রোগটি কলকারখানা, হাটবাজার, গানের আসর, ধর্মীও অনুষ্ঠান, নির্বাচন প্রচারণা, মিছিল মিটিং থেকে তেমন একটা ছড়ায় না বলে সরকার আন্দাজ করেছে। তাই এগুলো বিন্দাস খোলা আছে । রোগটি শীতে বেশি ছড়ানোর কথা থাকলেও আমাদের দেশে এসে কিন্তু গরমে বেশি ছড়াচ্ছে । কী আজব দেশ মাইরে !
সরকারি অবরোধ । সবাইকে মানতে হবে ; বিশেষ করে মধ্যেবিত্ত কিংবা গরিবদের জন্য বেশি কড়াকড়ি। গভীর চিন্তায় আছে আশু মণ্ডল । সামনে রোজার মাস । আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি । রোজার কিছু কেনা কাঁটা আছে, এই উপলক্ষে শহরে এসেছে । পরিচিত মাসুদ শেখ, তাকে একটি ভাড়ায় চালিত রিক্সার ব্যবস্থা করে দিছে । রোজার আগের দিন পর্যন্ত চালিয়ে যত টাকা আয় হবে সব টাকা দিয়ে রোজার মাসের জন্য খাদ্য ক্রয় করবে । রোজা রেখে সারাদিন তো রোজ রোজ কামলা দেওয়া যাবে না । তাই বড় আশা করে শহরে এসেছিলো ; কিন্তু আশায় গুড়ে বালি হয়ে গেলো । 
দূর থেকে তাকিয়ে দেখে মন ভরলো না আমার । আমি বাঙালি, আমাদের বিশাল একটি বৈশিষ্ট্য আছে; দূর থেকে দেখে আমাদের প্রাণ ভরে কিন্তু মন ভরে না । কাছে যেতে হবে , ছুঁয়ে দেখতে হবে, সেটা হোক না কেন যত বড় ছোঁয়াচে রোগ। জাতি সূত্রে বৈশিষ্ট্য, এটা আমার মধ্যেও জেগে উঠলো ।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম," ভালো আছেন, চাচা ?"
-হ্যাঁ, কোথায় যাবেন? বলে একটি প্যাকেট গিট্টু দিতে লাগলেন ।
-চাচা, আমি কোথাও যাবো না । আপনি মনে হয় কিছু খাচ্ছিলেন?
- জী, চিরা । 
- আচ্ছা চাচা খাইতে থাকেন । 
খাখা রোদে ভাড়া টারা কম, এই সুযোগে দুপুর বেলার খাদ্য হিসেবে চিরা যেন এই গরিব পিতার মাংস-ভাত; আপন মনে খাইতে লাগলেন । নিরিবিলি শান্ত মন। ঐ বুঝি একটাই চিন্তা । আল্লাহ্ পথ দেখাও, আল্লাহ্ রাস্তা দেখাও । এই গরমে তবুও তাদের মন নরম, তাদের মন সাক্ষ্য দেয়, তারা মাটির তৈরী জীব । তাদের ইচ্ছে দু'বেলা দু'মুঠো ভাত মাছ । আর কিছু নয় ।
- চাচা মিয়ার বাসা কোথায়? (আবার জিজ্ঞাসা করলাম)
- গদাই গা চর , টেকের বাজার , সদর মাগুরা ।
- কালকে তো চাচা লক ডাউন চলবে, বাড়িতে যাবেন কেমনে ?
- আল্লাহ্ তালা আমাদের জীবন জুড়ে লক ডাউন করে দিছে । তবুও চলছি । সরকারি লক ডাউন দিয়ে কী করবে বাবা আমাদের! 
কথা শুনে আমার মনে হল, জন্মই যেন এই মানুষগুলোর আজন্ম পাপা ।
দুপুর বেলা । ভাড়াও তেমন একটা নেই । কথা বলার মানুষ একটা পেয়েছে । গরিবের জীবনের গল্প কেউ শুনেন না । আমাকে পেয়ে শুরু করে দিলেন তার কষ্টে ইতিহাস কথাবলি । 
দীর্ঘ সময়ের কথায় উঠে আসলো তার জীবনের এক বছরের চিত্র । তার পাঁচ জন মেয়ে । সচেতন মনে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে । ফলাফল যা পেয়েছে তা শুনে কষ্টে বুক ভরে গেলো 
বড় মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে দু'বছর বেকার । যৌতুক দিতে না পেরে বিয়ে হচ্ছে না । আবার ঘুষের টাকা দিতে না পাড়ায় চাকরিও হচ্ছে না । অন্যদিকে আবার সব চাকরি পরীক্ষা ঢাকা কেন্দ্রিক । শিক্ষিত মেয়েদের জন্য চাকরি পরীক্ষা হয়ে উঠেছে কাঁটা গাঁয়ে নুনের ছিটার মত। গরিবের শিক্ষিত মেয়ে আজ বাবার গারের বোঝা হয়ে দাড়িয়ে আছে কমলা, রহিমা, আসেয়া, পারুল ও বৃষ্টি। এত দিন টিউশনি করে মেয়ে গুলো চলতো  । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টিউশনি বন্ধ । মানবতার জীবন চলছে । তার উপর আবার লক ডাউন । 
কী খেয়ে বাঁচবে? সাত জনের সংসার ।পিতা এখন ক্লান্ত ।