পেনশন

পেনশন

নাজনীন নাহার 


ঘন্টা দু'য়েক হলো আমি মারা গেছি।মারা যাবার সময় আমি আমার ছোট মেয়ের বাসায় ছিলাম।শহরের বাসা।ছয়তলা বাড়ির চারতলায় মেয়ের ষোলোশ স্কয়ার ফিটের বাসা।ফ্লাটটা মেয়ের নামে মেয়ের টাকায় কেনা। মেয়ে আমার ব্যাংকে চাকরি করে।মেয়ের জামাইও একই ব্যাংকে আছেন।

পাঁচ মেয়ে আর বড়ো শখের একমাত্র একখানা ছেলে আমার।আল্লাহর কাছে বড়ো বেশি চেয়ে চিন্তে পাঁচ মেয়ের পড়ে একখানা সোনার মানিক পেয়েছিলাম।তাকে মাথায় রাখি না-কি মাটিতে রাখি এভাবেই নিজের সর্বোচ্চ সাধ্য সাধনায় তার বয়স বাড়িয়েছি।মানুষ করতে পারিনি।সেই ছেলে আমার রিহ্যাবে আছে।অতি ভালোবাসায় উচ্ছন্নে গেছে।তবুও কবরে শোয়ার আগে তাকে একবার শেষ দেখা খুব দেখতে ইচ্ছে করলো।কিন্তু কাউকেই যে সেকথা বলতে পারছি না ডেকে।আমি যে মারা গিয়েছি।আমি কিভাবে আর আমার চাওয়া পাওয়া জানাব!

হায় রে মানুষ! 
তুমি সময় থাকিতে না সাধো সাধন,
অসময়ে কাঁদো দহনে।
আপন ভজিয়া ভজে যাও যারে,
আপন নহে সে ভুবনে।

আজ ঈদের তৃতীয় দিন। গতকাল রাত থেকেই আমার মেয়ে, জামাইরা ও নাতিপুতিরা এই ছোটমেয়ের বাসায়।যেখানে আআমি আজ মারা গেলাম।গত তিন মাস আগে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসে করোনার জন্য আঁটকে গেলাম।আর ফেরা হলো না নিজের গাঁয়ে।ফেরা হলো না মায়ের কাছে।কী জানি মেয়েরা আমায় কোথায় দাফন করবে।একে একে আমার পাঁচ মেয়ে জামাইরা নাতি পুতি একবার করে আমার নিথর দেহের মুখখানির উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে সরিয়ে দেখছে।মেয়েরা থেমে থেমে কান্নাকাটি করছে।ভালো ভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এ কান্না দায়সারা কান্না। বাবা মারা গেলে কাঁদতে হয় তাই দু'দণ্ড কেঁদে নিলাম আর কি!

ভবের দুনিয়াদারি মোহে মোহে কাটে,
ভুলে ভুলে ভুলে থাকি জীবনের মানে।

কী অদ্ভুত জগত সংসার।যেই সন্তানদের জন্য সব নিঃশেষ করলাম সেই সন্তানের কাছেই বেঁচে থাকার শেষ কয়েকটা বছর কেমন অপাঙক্তেয় হয়ে গেলাম।আর আজ আমার মেয়েরা তাদের সন্তানের জন্য দুনিয়া উজার করে দিচ্ছে। কয়েকটা বছর গেলেই ঠিক আমার মতো যে তাদেরও অবস্থা হবে তা একবারও মনেই করছে না।

হায় রে প্রকৃতি হায় তোমার নিয়মের সহজ হিসাব।জটিল মানব মস্তিষ্ক তা বোঝে না।

কোথায় দাফন করবে।কত কত খরচ হবে।কে কে সাথে যাবে।এসব নিয়ে এখন ওদের হিসাব নিকাশ।আর কার এখন হাত খালি কে কত দিবে বা দিতে হবে এসব জটিলতায় আমি এখন জীবন থেকে পেনশন নিয়ে লাশ নামে পড়ে রইলাম।খুব বিরক্ত লাগছিল সব। একবার ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি। আমাকে আমার মায়ের কবরে নিয়ে যাও।কিন্তু পারছি না।কিচ্ছু বলতে পারছি না।মৃত ব্যক্তির আত্মা বলতে পারে না মুখে।যদি মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিত কারও সত্যিকারের প্রেম থাকে ভালোবাসা থাকে তাহলে সেই ব্যক্তি ওই মৃত ব্যক্তির আত্মার প্রায় সব কথা বুঝতে পারে। 
কিন্তু আমার তো কেউ নেই এখানে অতটা আপন।তাহলে তো ওরা বুঝতে পারতো বাবাকে কিছু টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাই।ওরা বুঝতে পারত ভাইটাকে একটু বাবার কাছে আনানোর ব্যবস্থা করি।সে-ই তো শুধু অনুপস্থিত এখানে। যাদের দুনিয়াতে আমার বলে জানতাম ও আমার বলে রেখে গেলাম।

নাহ তা নেই।কেউ নেই।আপন কেউ নেই আমার।ওই তো ওরা লাশ লাশ বলে সম্মোধন করছে আমায়।এখনই আমি কয়েক ঘন্টায় বাবা বদলে লাশ হয়ে গেলাম।বাহ সন্তান আহা সন্তানের মোহ!
এই সন্তানদের জন্য খেটে খেটে জীবন দিলাম!

আহা ভাগ বাটোয়ারা চলছে আমার শেষ বিদায়ের খরচপত্রের।ওরা সকলে চাকরি করে। আমি আমার পাঁচটা মেয়েকে এম এ পাশ করিয়েছি।কেউ ব্যাংকে,কেউ কলেজে,কেউ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। কিন্তু এখন ওরা কত দরিদ্র এক এক জন।ওরা ফ্লাট কিনছে, ওরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের দামী দামী ডিভাইস কিনে দিচ্ছে। কিন্তু বাবার কাফনের কাপড় ভাগের টাকায় কিনছে।

একবার মনে হলো ওদের ডেকে বলি।মাগো তোরা আমার লাশ আঞ্জুমান মফিদুলে দিয়ে দাও। কিন্তু তাও বলতে পারলাম না।এই হলো সাধের জীবন সাধের সন্তান। ওদের কত যত্ন করে মানুষ করেছিলাম।মানুষ! মানুষ কী করতে পেরেছি!নাহ পারিনি।পারিনি বলেই আজ নিজের বাবার দাফনের টাকা পাঁচ পাঁচটা মেয়ে ও জামাই মিলে ভাগ করে করে সময় নষ্ট করছে।
আর এক মুহূর্তও আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।নিজের সন্তানদের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার।ভাগ্যিস ওদের মা আগেই মারা গেছে।নইলে আজ বেঁচে থেকে আমার এই দুরবস্থা দেখে ধুঁকে ধুঁকে মরত।

আপনারা তো জানেন না আমি কেমন করে মারা গেলাম। শুনুন তাহলে, গতকাল ঈদের দ্বিতীয় দিন রাতে আমার সব মেয়েরা ছোট মেয়ের বাসায় আসল আমাকে দেখতে।আমার শরীর এখন অনেকটা সুস্থ। চারিদিকে করোনাও কিছুটা সহনীয়।আমি ঈদের পরে বাড়ি চলে যাব।অনেক দিন কোরোনার কারণে মেয়েরাও এ বাসায় আসেনি।তাই আসা।আমাকে দেখতে আসা।সাথে জামাইরাও এলো।নাতিপুতিরা সহ।আমি খুব খুশি হলাম সেবাই আমায় দেখতে এসেছে।কত ভালোবাসে আমাকে।কিন্তু আমাকে তারা দেখতে আসেনি।এসেছে আমায় চিরতরে পেনশনে পাঠাতে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার শেষ করে সব বাচ্চাটা আমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে আমার মেয়ে ও মেয়ে জামাইরা এক রুমে বসে গল্প করছিলো।আমার নাতিপুতিরা সকলে মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে গেলে কেমন নিস্তব্ধতা নেমে এলো ঘরে।আমার কানে তখন ভেসে আসতে থাকল আমার মেয়ে ও জামাইদের কথাগুলো। তারা আমার গ্রামের বাড়ি, আমার কিছু জমি, আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পেনশনের টাকার ভাগ বাটোয়ারা করছে।কে কত পাবে।সব তো কুলাঙ্গার ভাইটার পেছনেই খরচ করছে বাবা।তাদের কী কোনও অধিকার নেই! ইত্যাদি। 

ভাগ্যিস আমার ছেলেটা নেশা করে ঝিমায়।ঠিকমতো চেতন নাই। ভালোই হয়েছে এখন সে মা বোঝে না,বাবা বোঝে না।আমার পেনশনের টাকাও বোঝে না।আমার সুস্থ সুন্দর শিক্ষিত মেয়েদের মতো হলে আজ সে-ও এই সকল ভাগ বাটোয়ারায় সামিল হতো।আজ কেন যেন আমার ছেলেটার জীবন সঠিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ-ই ভালো দুনিয়ায় এতো এতো লোভ,স্বার্থপরতা থেকে দূরে আছে ছেলেটা।ওর জীবন কোন কিছুতেই টানে না।তুই ভালো থাক খোকা।

তবুও গতরাতে আমার মেয়েদের এসব কথা ও ভাগ বাটোয়ারার বিতণ্ডতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি তো এখনও বেঁচে আছি। এখনও নিজের টাকায় নিজের চিকিৎসা করাই,খাইদাই।ছেলের জন্য খরচ করি।আর এখনই ওরা এগুলো নিয়ে ভাগবাটোয়ারায় লেগে গেলো।আর তাদের মধ্যে সেই কী চাপা উত্তেজনা। কথা-কাটাকাটি। আমার আর সহ্য হলো না।এক মুহূর্ত আর বাঁচতে ইচ্ছে হলো না।মাথাটা কেমন সো সো করে ঘুরে উঠল।খুব পানির তেষ্টা পেল।আর কিছু মনে নেই। আমি পড়ে গেলাম ওদের মিটিংরুমের দরজার সামনে।আর ওই তো শেষ। মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে ফজরের আজানের পর মারা গেলাম।একেবারেই জীবন থেকে পেনশনে চলে গেলাম চিরতরে।

এখন তোরা আমায় কবরে শুইয়ে দিয়ে আমার সব ভাগ করে নিয়ে নে।তোরা ভালো থাক আমার প্রিয় সন্তানেরা।আমি আর তোদের কাছে ফিরব না।তোদের বাবা থেকেও অবসর নিয়ে লাশ নামের পেনশনে নাম লিখালাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই চিরতরে পেনশনে চলে যাচ্ছি তোদের বিরক্তিকর বাকবিতণ্ডার মায়াহীন অমানবিক পৃথিবী থেকে।

কেউ আমাকে গোসল করাচ্ছে। আমি এদের কাউকে চিনতে পারছি না।আমার সন্তানদের আমি নিজ হাতে কতো গোসল করিয়েছি। আমায় ওরা কেউ একবেলাও গোসল করাতে পারলো না।আহা আবারও ছেলেটাকে খুব মনে পড়ছে।ওর হাতে গোসল করতে ইচ্ছে করছে।

আমার বাবাকে খুব মনে পড়ছে।মনে পড়ছে খুব মা'কে।আমাকে কে যেন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাপড় পড়াচ্ছে।শরীরটা খুব আরাম পাচ্ছে আমার।একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছি।চেনা মুখ আর কাউকেই দেখছি না।

আমার এমন একা একা লাগছে কেন!কেন মেয়েগুলোর মুখও খুলে করে মনে পড়ছে।ওদের যে আমি অনেক ভালোবাসি।আল্লাহ ওদেরকে ক্ষমা করে দিন।ওদেরকে ভালো রাখুন।আমি তো বাবা।সন্তান থেকে বাবা নিজে কখনোই পেনশন নিতে পারে না।

ভবের এই খেলা ঘরে, 
এলাম গেলাম কোন কারণ।
তোমারই লীলাখেলায়, 
বেভুলে জীবন দিলাম।
কে আমার রইল আপন, 
কে আমায় পর করিল। 
শূন্য এ ভবের নেশায়, 
শূন্য হয়েই চলে গেলাম।