প্রযুক্তি প্রসঙ্গ ও জন্মস্হানের কিছু বিস্মৃতি
মোঃ হাবিবুর রহমান
আমি যে গ্রামে জন্মেছি সে গ্রামটি যেন প্রযুক্তিতে এখন বেশ যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে। বছর দুই আগে গ্রামে বেড়াতে যেয়ে আমি আমার আব্বা, মা, দাদী ও দাদাসহ পূর্ব পুরুষদের কবর জিয়ারতের পর যখন হারু চাচাদের বাড়ি হয়ে মল্লিক পাড়ার যখন কাছাকাছি পৌঁছালাম ঠিক তখনই চোখে পড়লো প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার।
খেলা পাগল শফি চাচার নেতৃত্বে এক ডজন খেলা প্রেমিক বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা বসে-বসে বিশ্ব মহিলা ক্রিকেট খেলা উপভোগ করছে স্যাটেলাইট টেলিভিশনে। দেখে বেশ ভালো লাগলো, প্রযুক্তির এই উত্তম পরিবেশ দেখে। গর্ব বোধ করলাম আর ভাবলাম হায়রে, আমার আব্বা একদিন বলতেন পুরো চুয়াডাঙ্গা শহর কুড়িয়ে টেলিভিশনের সংখ্যার হিসেবটি ছিল নাকি মাত্র চৌদ্দটি আর এখন এর সংখ্যা নিঃশ্চয়ই হবে চৌদ্দ এর গুণিতক সাত হাজারের কম নয়।
গ্রামটি যেন শহরের মতই হয়ে গেছে। বাঁশ-ঝাঁড়ের সেই বিশাল-বিশাল বাগানগুলোর সমাহার আজ আর অবশিস্ট নেই। নবগঙ্গা শুকিয়ে বেশ সরু হয়ে গেছে, দেখে মনে হয় তার উপর সভ্য সমাজের মনুষ্যজাতি কর্তৃক একটা লম্বা সময় ধরে যারপরনাই বুঝি অত্যাচারের খড়গ চালানো হয়েছে। নবগঙ্গা বুঝি তাই কিছুটা অভিযোগ ও অনুযোগ করে বললো দেখো ভাই "তোমরা নেই তাইতো বুঝি আমার এই হাল-হাকিকত"।
এরপর সেই উত্তর পাড়া বা হিন্দু পাড়ার দিকে গেলাম, প্রাথমিক বিদ্যালয়টা একা-একা দাঁড়িয়ে আছে, মনটা বুঝি এর বেজায় খারাপ। আজ মন্টু বাজিগররা যাদু প্রদর্শন করতে এখানে কেন যেন আর আসেনা। সেই পদ্মবিলে আর কেন যেন পদ্ম আর ফোটেনা।
ওদিকে ঈদগাহের মাঠে যেয়ে একটু বেকুপই সেজে গেলাম আরকি। দেখলাম, এরই মধ্যে ঈদগাহ তার ভোল পাল্টিয়েছে অনেকখানি। ঈদগাহটাকে নিয়ে বেশ ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। ঈদগাহের মাঠে সারি সারি কাঁঠাল গাছ এমনভাবে লাগানো হয়েছে যেন নামাজের কাতার বানাতে আর কোনই অসুবিধা হয়না। আবার মুসুল্লিরা নামাজের সময় পর্যাপ্ত ছায়াও পায়। ভাবলাম, এ প্রজন্মের পোলাপানদের বুদ্ধির যেন জুড়ি নেই। এদিকে ঈদগার মাঠও যেন প্রশস্ত হয়েছে অনেকটা। বোধ হয় কিছু জমি কিনে ওরা বাড়িয়েছে ঈদগার মাঠও।
বিদ্যুতের ঝলকানিতে আর জোৎস্না রাতে সেই জারি-সারি কিংবা পালা গানের আসর আর বসেনা। জোনাকীরা তাই অভিমান করে পার্শ্বের বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে পালিয়ে বেঁচেছে। ঝড়োদের কদবেল তলায় যে খায়বার চাচা আর শাহাদৎ দাদা কারিসমাতি লাঠি খেলা খেলতো, সেই লাঠি খেলার আসর আর বসেনা, বোধ করি খায়বার চাচা ও শাহাদৎ দাদা তাদের জীবদ্দশায় কোন উপযুক্ত উত্তরসুরী বা সাগরেদ বানিয়ে রেখে যাননি।
ওদিকে হঠাৎ সাদন চাচার ডাক পড়েছে, তিনি ফরমায়েশেন যে, আমি ফেরার আগে যেন চাচীকে দেখে যাই। সাদন চাচা ওরফে মুহম্মদ চাচা আমার আব্বার ছোট কালের বন্ধু। শুনেছি তিনি নাকি আমার আব্বার বয়সের চেয়ে দশ মাসের ছোট। ওনার সামনেই আমার জন্ম। তাই ছোট বেলায় তিনি আমাকে বড্ড আদর করতেন। মনে আছে আমার আব্বার সাথে বহু রাত তিনি একত্রে আখক্ষেতে পালিয়ে রাত গুজরাণ করেছেন রাজাকারদের ভয়ে, তাই রাজাকারদের উপর আমার সেই চাপা রাগ আর ক্ষোপটা এখনও অনেক কষ্টে বয়ে বেড়াচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু একবার আমাদের দ্বিতীয় রাজধানী চুয়াডাঙ্গা শহর পরিদর্শনে এসে টাউনহল মাঠে বিশালাকার এক হেলিকপ্টার নামিয়েছিলেন এবং তাঁকে একনজর দেখার জন্য আমি এই সাদন চাচারই কাঁধে উঠেছিলাম।
তুফার বাপ মন্সুর ভাইকে খোঁজ করে দেখলাম মন্সুর ভাই বেশ কিছুদিন হল ইহধাম তাগ করেছেন, মনটা তাই খুবই খারাপ হয়ে গেলো। গতফিরে এসে মন্সুর ভাইকে যৎসামান্য পয়সা দিয়ে গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য।
ওলি চাচার মা সেই শতবর্ষী দাদীকে গত ফিরে বাজারের রসগোল্লা খাইয়ে এসেছিলাম অবস্হা বেগতিক দেখেই হয়তোবা। এই ফিরে যেয়ে আর তার দেখা মেলেনি। আহা বেঁচে থাকাকালীন তাকে আমার কাছে যেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর ইন্দিরা গান্ধীসম মনে হতো। তার আদেশ ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল সত্যই অসীম ও অসাধারণ। ঐ দিকে আবার সোবারেক চাচার বাপ হামদো দাদাও যিনি দেখতে আমার কাছে অনেকটা আরবীয় মনে হতো তিনিও কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল ফরমাইয়েছেন।
সবকিছু মিলে গ্রামটা যেন আগের মত আর নেই, যেন কেমন পর পর লাগলো, সবই যেন কেমন ফিকে হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের পোলাপান আমাকে অনেকেই চিনেইনা, তাই বাবার পরিচয় দিয়ে নিজেকে চেনাতে হয় তখন অবশ্য বড্ডই অস্বস্তি বোধ করি। কিবা করার অাছে? সব দোষতো আমারই। কথায় বলে "আদান-প্রদান না থাকলে আপন স্বজনেরাও পর হয়ে যায়"।
বড় আবুল ভাইকে গতবার এসে দেখা মিলেছিলো কিন্তু এবার এসে আর তাকে পাইনি। হে আল্লাহ তুমি তাকে মাফ করে দিও। আমি আবুল ভায়ের কাছে অনেক ঋণী। শুনলে অবাক হবেন যে, ছুটি শেষে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রত্যাগমনের পূর্বে এই আবুল ভাই তার মাথায় করে প্রায় দু' মাইল রাস্তা আমার লাগেজটি বহন করে সরোজগঞ্জ বাজার পর্যন্ত এসে ঝিনাইদহগামী বাসে তুলে দিয়ে যেতেন। আবুল ভাইয়ের জন্য দোওয়া করা ছাড়া আজ আর বুঝি আমার কিছুই করার নেই।
"ইনহাস্ত ওয়াতানাম"-এটাইতো আমার জন্মভূমি। আপনাদের ভাল না লাগলেও আমার কাছে কিন্তু এ স্মৃতিচারণ খুবই ভাল ও মধুর লাগে। কথায় বলেনা "জননী জন্ম ভূমিশ্চঃ স্বর্গদোপী গরিয়সী।