বাংলা ভাষা প্রচার ও প্রসারে করণীয়' (সকল ভাষা শহীদদের স্মরণে উৎসর্গীকৃত)-
মোঃ হাবিবুর রহমান
এ জগতে অহর্নিশ বুঝি এরকমই ঘটে চ'লেছে। বাবা জমি কিনে রেখে গেলেন কিংবা আলিশান একটা বাড়ী বানিয়ে রেখে পরলোকে পাড়ি জমালেন আর তা তাঁর সন্তানেরা বা আওলাদরা তাদের বাবার মৃত্যুর পর ষোল আনাই ভোগদখল ক'রলো আর অভাগা বাবা কিনা শুধু জমি কেনা পর্যন্তই আয়ূ নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলেন আর তাই ভোগদখল তো তাঁর কপালে আর জুটলো না।
এভাবে জনৈক্য বৈজ্ঞানিক কোন একটা যন্ত্র আবিস্কার করার অব্যাবহিত পরেই ইন্তেকাল ফরমাইলেন এবং তিনি তার আবিস্কারের কিয়দংশ সুফলও ভোগ ক'রতে পারলেন না। অথচ, সারা বিশ্বব্যাপী সৃষ্টির সেরা মানুষেরা এর দ্বারা দিবারাত্র আজও প্রভূত উপকৃত হ'চ্ছেন এবং এইভাবে হয়ত একইভাবে অনাদিকাল পর্যন্ত সর্বদা উপকৃত হয়ে যাবেনও। আসলে সব কিছুর মুলেই বুঝি র'য়েছে নিয়তির ইশারা।
এভাবে ভাবুন তো একবার; ৫২' তে যারা জীবন দিয়েছে সেসব অকুতোভয় ভাষা সৈনিকগণ যথাক্রমে সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার ও অন্যান্যরা নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তথা মহামূল্য জীবনের বিনিময়ে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাটিকে সুসমুন্নত রেখে গেছেন তাই তাদের সে রক্তের ঋণ আমরা কিভাবে শুধিব?
তারা তো কোন বিজ্ঞানীর মত মানব কল্যাণমূলক কোন যন্ত্র তৈরী করা কিংবা বাবার মত সন্তানদের জন্য কোন জমি-জায়গা কেনাকাটা বা বাড়ী তৈরী করে রেখে যাচ্ছেন না ঠিকই কিন্তু ভাষা শহীদগণ তাদের মহামূল্যবান জীবনের বিনিময়ে বাংলাকে বর্তমানে আন্তর্জাতিক একটা ভাষা হিসেবে উপহার দিয়ে গেছেন।
আর এর চেয়ে মানুষ আর কি অধিক ত্যাগ স্বীকার করতে পারে কিংবা বিসর্জন দিতে পারে? ভাষার জন্য জীবন বিসর্জনকারী শহীদগণ এত বড় ত্যাগ স্বীকার ক'রে নিজের জীবন বলিদান ক'রলো শুধুমাত্র নিজের প্রিয় মাতৃভাষাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তাহ'লে এখন প্রশ্ন হ'চ্ছে যে, আমরা কি তাদের রক্তের প্রকৃত মূল্য দিতে পারছি বা পেরেছি?
আমরা শুধুমাত্র প্রতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাত্রি বা ২১ ফেব্রয়ারীর মধ্যরাত ১২ টা ১ মিনিটে জাতীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক প্রদানের মাধ্যমে বা একটা দায়সারা গোচের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে কোন রকম আমাদের সকল ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে বোধ হয় আমাদের সকল প্রকার জাতীয় দায়িত্ব শেষ করছি প্রতি বছর।
এ যেন অনেকটা এমন যে, সারা বছর কোন খাবার না খেয়ে বছরে শুধুমাত্র একদিন পেটপুরে খেয়ে মনে মনে বিশ্বাস করা যে, একদিনের ঐ খাবারেই তার সারা বছরের খাওয়া হ'য়ে গেছে; সুতরাং বাকী ৩৬৪ দিন বা সারা বছরের আর কোন দিন খাওয়ার দরকারই নেই আরকি!
বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ ক'রলো কিন্তু আমরা নিজেরাই তো শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষায় সর্বদা কথা বলার চেষ্টা করা কিংবা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিৎ করার ব্যাপারে পুরো জাতি যেন আজ ভীষণভাবে উদাসীন।
আমার মতে ভাষা শহীদদের প্রতি প্রকৃত সন্মান দেখাতে হ'লে বাংলা ভাষাকে অধিকতর প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে এবং এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে সারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত করাতে হবে অার তখনি বুঝি এসব শহীদদের প্রতি যথাযথ সন্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হবে আর তা নাহলে যা কিছু করা হবে বা হ'চ্ছে তা সবই হবে অনর্থক ও অর্থহীন।
আমার মতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে কিংবা সম্প্রসারণের স্বার্থে নিম্নের পদক্ষেপগুলো সত্বর আমাদের সবার ব্যক্তিগতভাবে ও জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বতার সাথে বিবেচনায় আনতে হবেঃ
(১) প্রতিটি উপজেলায় আপাতত ষান্মাষিক ও বার্ষিক ভিত্তিতে কবিতা, গান, ছড়া, গদ্য ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। এভাবে প্রতিযোগিতা উপজেলা, জেলা, বিভাগ হ'য়ে জাতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এনে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা। বিভিন্ন প্রকার প্রচার মাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন ক'রবে। পুরস্কারের অংক অবশ্যই আকর্ষণীয় ও বড় হ'তে হবে।
(২) বাংলা ভাষাকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের পুরা মাসটা বাংলায় কথা বলার জন্য সব মহলে জোর চেষ্টা চালানো। তবে যে সব স্কুলে ইংরেজী মিডিয়াম আছে বা ইংরেজীর বাধ্যবাধকতা আছে তারা ইংরেজী চর্চার পাশাপাশি বাসায় অবস্থানকালে সর্বদা ছাত্র ও ছাত্রীরাসহ পরিবারের সকল সদস্যরা বাংলার চর্চা ক'রবে যা অবশ্যই বাবা-মায়েরা পরিবারের অভিভাবক হিসেবে এ বিষয়ে তাদেরকে বাধ্য ক'রবে।
(৩) অফিস-আদালত কিংবা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য সকল প্রতিষ্ঠানে চিঠিপত্রের আদান প্রদান বাংলাতে করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
(৪) প্রিন্ট মিডিয়া বা টেলিভিশন মিডিয়াকে বাংলা প্রচার ও প্রসারে সার্বক্ষণিকভাবে ব্যাপক ভূমিকা পালন ক'রতে হবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয়ভাবে পলিসি অনুযায়ী মিডিয়া তাদের অনবদ্য প্রচার চালাবে।
(৫) বিদেশী নামী-দামী লেখক ও লেখিকাদের লেখা বইগুলো বাংলায় অনুবাদ ক'রে লেখক এবং লেখিকাদের স্বদেশে বিনা পয়সায় কিংবা বিনালাভে পাঠানো যেতে পারে। এতে বাংলা শিক্ষার জন্য বিদেশীরাও আস্তে আস্তে উৎসাহী হ'য়ে উঠবে।
(৬) বাৎসরিক বইমেলাগুলো বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে সারা বছর ব্যাপী আলাদা আলাদা সময়ে অনুষ্ঠিত হ'তে পারে যা কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয়ভাবে মেলার দিনক্ষণ ঘোষণা দিতে পারেন। কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলা একাডেমী এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ক'রতে পারে।
(৭) সর্বোপরী যারা প্রবাসী তারা বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে দারুন একটা ভূমিকা রাখতে পারে। রচিত বাংলা বইগুলো প্রবাসের স্থানীয় ভাষায় তাঁরা তরজমা ক'রে বিদেশী নাগরিকদের হৃদায়াঙ্গণ করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন ক'রতে পারেন।
(৮) মোট কথা হলো যে, যেকোন কঠিন জিনিসই হোক না কেন তা যদি সমগ্র জাতি একসাথে ও একযোগে কমিট ক'রে থাকে তাহ'লে তাদের সকল মহতী কার্যকলাপগুলো সুসম্পন্ন করা বা কমিটমেন্ট ঠিক রেখে মরিয়া হ'য়ে তা সম্পাদন করা মোটেই অসম্ভব কোন ব্যাপার না।
তাই পরিশেষে বলবো যে, বাংলা বলা শুধুমাত্র বছরের ০১ (এক) দিনের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ না ক'রে বছরের প্রতিটি দিনকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সারা বছর ব্যাপী বাংলা চর্চার অনুসঙ্গগুলো কাজে লাগাতে পারলেই বুঝি বাংলার প্রচার ও প্রসার সুদুর-প্রসারী হবে ও সেই সাথে ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ সন্মান প্রদর্শন করাও সম্ভব হবে আর উপরোক্ত বিষয়গুলো উপেক্ষা ক'রলে বাংলা ভাষা সামনে অগ্রসর না হয়ে বর্তমান জায়গায়ই নিশ্চল থাকবে এতে বিন্দু পরিমাণ কোন সন্দেহ নেই।
সবশেষে ভাষা শহীদদের স্মরণে নীচের কবিতার কতগুলো লাইন উৎসর্গ করলামঃ
ভাষা শহীদদের স্মরণে
মোঃ হাবিবুর রহমান
যে ভাষাতে মোরা কথা বলি,
যে ভাষায় আমরা স্বপ্ন দেখি;
যে ভাষায় করি মান-অভিমান,
যে সুরে গাই জারি-সারি গান,
সে তো অন্য কোন ভাষা না,
সে আমারি প্রিয় বাংলা ভাষা।
তোমরা যারা তাজা রক্ত ঢেলে,
বাঁচাইয়া রাখিয়াছ বাংলাটাকে,
সহস্র সালাম তোমাদেরই তরে।
আমরা রাখিব তোমাদের মান,
ম্লান করিবনা তোমাদের সন্মান।
বাংলা ব্যবহারে রাখবো অবদান,
বাংলাকে ছড়াবো সারা বিশ্বময়।