বাংলার বীর

বাংলার বীর

শাহীন সুলতানা 

তখনো জন্ম হয়নি আমার।

যখন তোমার বজ্র কণ্ঠের উত্তাল তরঙ্গ ধ্বনি আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে করতে বাঙালীর বুক ফুঁড়ে তাদের হৃদয়ে ঝংকার তুলেছিল। 

তখনো জন্ম হয়নি আমার- যেদিন তোমার বজ্র ভাষণে বাঙালি জাতি বীরদর্পে ঝড়ের বেগে উজ্জীবিত হয়েছিল...যেদিন তোমার সুউচ্চ আওয়াজ বাঙালিকে ঘরছাড়া করেছিল লড়াই করতে।

হ্যাঁ তুমিই সেই পুরুষ, যে বুঝিয়ে দিয়েছিলে- নির্যাতকের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকতে গেলে কি করে অধিকার অর্জন করে বেঁচে থাকতে হয়। কি করে মাতৃভূমিকে মায়ের মতোই ভালোবাসতে হয় আর যোগ্য পিতা হতে গেলে- কিভাবে ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে সন্তানকে বুকে আগলে রাখতে হয়।

তুমি বুঝিয়ে দিয়েছিলে- অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ নয়, অত্যাচারীকে ছাড় দেওয়া নয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে জীবনের প্রয়োজনে সংগ্রাম করে কিভাবে টিকে থাকতে হয়।

জীবনের যে সময়টাতে মানুষ সংসার, সন্তান, স্বপ্ন নিয়ে জীবন উৎসর্গ করে দেয়, সেই সময়টাকে তুমি দিয়েছিলে অকাতরে বিসর্জন। দিয়েছো স্বাধীনতার ডাক, টেনেছো জেলের ঘানি। জেল-জুলুম- নির্যাতনে তুমি পরাস্ত হওনি বীর! তুমি হারতে শিখোনি...নিজের সুখ-সমৃদ্ধি বিসর্জন দিয়েছো অনায়াসে দেশ আর দশের জন্য... হেসে গেছো মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত।

যেদিন ঘোষণা দিলে-" রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো- দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ..." সেদিন তোমার তর্জনীতে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব আর নেচেছিল পূর্ব বাংলা।

অত্যাচারীর বুকে বজ্রপাত ঘটেছিল মূহুর্তের মধ্যে। তাইতো দিশেহারা দখলদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আক্রমণ করেছিল আমাদের মাতৃভূমি। শেষ করে দিতে চেয়েছিল তোমার সন্তানদের। এমন নৃশংস আর মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল।

চার দেওয়ালের মধ্যে আটকা থেকেও তুমি স্বপ্ন দেখেছো- একটি স্বাধীন পতাকার, একটি স্বাধীন জাতীর। তোমার তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠের বারুদে আলোড়িত হয়েছে দেশ, জাতী আর বাঙালির কলিজা। তুমি লড়তে জানো, তুমি নাড়াতে জানো পিতা!

এরপর, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধে জয় হলো আমাদের। তুমি পেলে সাত কোটি সন্তান, একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশ আর বিপর্যস্ত অর্থনীতি। তবু্ও তুমি স্বপ্ন দেখলে,স্বপ্ন দেখালে। সমস্ত দুঃখাশ্রুকে আনন্দ অশ্রু হিসেবে বুকে ধারণ করলে। তেলে- জলে, ফুলে- ফসলে চারিদিকে যখন মৌ মৌ গন্ধে ভরপুর... ওদের সহ্য হলো না, তোমাকে সরিয়ে দিতে চাইলো।

তারপর কিছু বিপথগামী শৃগাল, মেরুদণ্ডহীন কুটিলের ছকবাঁধা জালে তুমি আটকা পড়লে। যাদের চেহারা অবিকল মানুষের মতো দেখতে কিন্তু ভিতরে ছিল দানবের অবয়ব।

ওরা বইয়ে দিল রক্তের ফোরাত! যে পিতার কোলেপিঠে চড়ে মানুষ হলো ঐ বিচ্ছুর দল, সেই পিতার রক্ত-গঙ্গায় স্নান করালো ওদের শরীর!

বিশ্ব কেঁপে উঠল হায়েনার তাণ্ডবে। বাঙালি হলো শোকাতুর-অশ্রুসিক্ত... বেদনায় মূহ্যমান। লজ্জ্বায় অপমানে যুদ্ধ বিজয়ী শির হলো ভূলুণ্ঠিত। 

বিশ্ব বিবেক স্তব্ধ হলো আর একবার। যে প্রদীপ- আলোর ঝলকানিতে ভরিয়ে দিয়েছিল জীবনের চারপাশ, সেই প্রদীপ

শিখাকে- অন্ধকার কূপে মাটিচাপা দেওয়া কতটা নৃশংসতা তা সেদিন তাকিয়ে দেখেছে বিশ্ব।

ওরা কেড়ে নিল তোমার জীবন, তোমার সংসার, তোমার সম্পদ, তোমার সন্তান... সব। রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিল ইতিহাস... কলঙ্কিত করলো স্বাধীনতার অর্থ।

সেদিন বাঙালি হয়েছিল পাথুরে মূর্তি... শোক স্তব্ধ ।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কাপুরুষের শক্তির কাছে বাঙালি হয়েছিল জিম্মি। স্বাধীন বাতাসে পতাকার পত্পত্ আাওয়াজ

হয়েছিল কান্নার সুর। মানচিত্র খামচে ধরেছিল শকুনের বিষাক্ত ঠোঁট। 

এরপর জন্ম হলো আমার... আমাদের। তোমার গর্জে ওঠা কণ্ঠ আর ইতিহাস- বারবার আলোড়িত করেছে তারুণ্য, উদ্দীপ্ত করেছে যৌবনের খেয়ালি সময়...যৌবনের প্রতি পদক্ষেপ প্রভাবিত করেছে তোমার আদর্শ... তোমার তর্জনী।

ওরা চেষ্টা করেছিল- ইতিহাস মুছে ফেলার... যেমনিভাবে তোমাকে মুছে দিয়েছে- ১৫ ই আগস্ট,১৯৭৫।

কিন্তু নাহ্.... তোমার বীরপুরুষ সন্তানেরা বীরদর্পে প্রতিহত করেছে সীমারের হাত। একটি ফুলকে ওরা নিশ্চিহ্ন করেছে বটে... ওরা জানে না- আজ হাজার হাজার ফুলের জন্ম হয়েছে বাংলায়।

খোকাকে আর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাবে না।

বেঁচে থাকো হে গুণী, সহস্র-অযুত বছর বাঙালির হৃদয়ে। 

বেঁচে থাকো মায়ের বক্ষে পরম মমতায়...।