মাকে যেমন দেখেছি
হাসান ফরিদ
সে আজ কতদিন--দেখিনি আমার মাকে--
জীবন নামের মেলট্রেনের চাকায়
লোহা-লক্করের ভাঙা চশমায়
দেখতে পাই স্পষ্ট --আমার মাকে;
দেখতে পাই :
আমার মা দাঁড়িয়ে আছে--সন্ধ্যাবাতির আগে;
নলগোড়া ঝাড়ু হাতে--বাড়ির ঘাটালে
লাউ-শিম গাছের সাদা-নীল ফাঁকে--চোখ তার
আটকে আছে
দেশে ফেরা লঞ্চযাত্রিদের ব্যতিব্যস্ত ভিড়ে,
তার সোনামানিক এলো কি ফিরে?
দেখতে পাই :
সেই ছোট্টবেলায়; ছইয়ে ঘেরা নাইয়র নায়ে
মা যেত বাপের বাড়ি--চেনাজানা গাঁয়ের মাঝি--
লাল গামছা বাঁধা আধাপাকা মাথায়; কপালে
বয়সী বটের ভাঁজ --সিঁদুর কাঠের বৈঠেতে ছলাৎ ছলাৎ শাপলা জলের সে কী কারুকাজ!
ধু-ধু গ্রামের কোনো বাড়ির ঘাটে বাঁধা --
পাটবোঝাই পানশি নৌকা দেখে--মাকে বলতাম,
'আর কত দূর--মা?'
মা সান্ত্বনা দিয়ে বলতো,
ওই যে পশ্চিমে --হোলদে শাড়ি পরনে--
তোর খালাম্মা--বড়শি পেতে দাঁড়িয়ে!
ক্ষুধা পেলে মা বৈয়াম থেকে--মোয়া-মুড়কি
তালের পিঠে--বুড়ো দাদির জন্য করা--চালকুমড়োর মোরব্বা খাইয়ে দিয়ে বলতো,
খাও খোকা! এইতো এসে গেছি!'
মায়ের পানচিবানো পিকের ফাঁকে--বোনদের চিমটি কেটে বলতাম,
'ওই দেখ, কুমির আইলো, শুশুক আইলো!
ভয়ে ওরা হাঁটু গেড়ে বসে পড়তো--
আমি তখন ঘুণে ধরা বাঁশের আড়ে ঠেস দিয়ে মরাগাঙে--কুচকুচে কালো জেলের ভেসাল জালে
তড়পানো রুপোলি চাঁদা মাছের মাঝে...
আরো মনে পড়ে:
বাঁশের মাচানে পাতা--নারিকেলের শাসের মতো
ফুরফুরে সাদা; কাজির ভাতের টকমিষ্টি ঝালের সাথে--পোড়া বেগুন ভর্তে আর টালা রসুনের
সেকি নির্ভেজাল কুটুম্বিতা ছিল!
মৌসুমি মসুর ডালের পিঠে খেতে খেতে
আচমকা পাথর মরিচ দাঁতে কেটে যখন
নোনাজলে চোখ ভরে উঠতো--তখন শত কাজের
মাঝেও--আঁচলে মুখ মুছে দিয়ে
মিঠাই-মণ্ডা পুড়ে দিতো...
দেখতে পাই :
চিরাচরিত আষাঢ়ের বাদলদিনে; সাতকন্যের নেমে আসার হোলদে কোটা লগনে--ভিজে চুলায় চাপিয়ে দিত মা; মুগ-মসুর আর কাঁঠাল বিচি--বাড়িশুদ্ধ
ভাজা-পোড়ার তুমুল গন্ধ যখন--আমি তখন কাঠবিড়ালি --নুয়ে পড়া ঢেঁকির শেষে
ছোলা-বাদামের খোলস ছাড়ানোর কাজে..
আজ সেই মা তেমনি আছে--শুধু আমরা
ব্যবধান পাতায় সেতুর কাহিনি রচনা করে
সফল নাটকের সহস্রতম মহড়ায়; স্মৃতিকে
চা-কফির শানকি বানিয়ে ; জীবনযুদ্ধের কয়লাখনিতে দক্ষ শ্রমিকের কালো তৈলাক্ত
আস্তিনে--সময়ের ছারপোকা নিধনে ব্যস্ত..
.
[বিশ্ব মা দিবসে পৃথিবীর সকল মাকে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ]