সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি

সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি

শাহীন চৌধুরী ডলি

মানুষের জীবন দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সময় তার শৈশব। শৈশবকাল খুব সংক্ষিপ্ত হলেও এই সময়কাল মানুষের আবেগে খুব বেশি করে জড়িয়ে থাকে ।শৈশবকালে মানুষের মন নির্মল এবং কোমল থাকে। তখন তাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া এবং তার দেখা পরিস্থিতিগুলো খুব গভীরভাবে মনে দাগ কাটে। সময়ের সাথে সাথে জীবনের নিয়মে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর আসে, তারপর তরুণকাল, যৌবন এবং বার্ধক্য আসে। কিন্তু মানুষ কখনোই তার শিশুকাল ভুলতে পারে না। একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতিগুলো নিজের শৈশবকে ঘিরেই। সবার মতন আমার শৈশবও অপরিমেয় মধুর স্মৃতিতে ভরপুর। 


আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। কিশোরী মায়ের কোল আলো করা, তরুণ বাবার চোখের মনি কলিজার টুকরা প্রথম সন্তান। জন্ম এবং শিশুকালের বেড়ে ওঠা পুরোটাই কেটেছে রাজধানী ঢাকায়। আমার ছোটবোন পলি ঠিক আমার আড়াই বছরের ছোট। আব্বু আম্মু আমাদের দুই বোনের জন্য সবকিছু একদম একইরকম কিনে দিতেন। জামা, জুতো,স্কুলব্যাগ,চুলের ক্লিপ,ফিতা থেকে ধরে সবকিছু একই ডিজাইনের এবং একই রঙের। আমার জন্ম ঢাকার শুক্রাবাদে। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বার বাড়ির অতি নিকটেই ছিল আমাদের শুক্রাবাদের বাসা। 


আমাকে ঠিক চার বছর বয়সে রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করা হলো। প্লে,নার্সারি, কেজি ওয়ান, কেজি টু তখন এগুলোর এত বালাই ছিলো না।  আমরা থাকতাম শেরে বাংলা নগরে জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কোয়ার্টারে। আমাদের বাসার সামনের রাস্তা মানিক মিয়া এভিনিউ। ঠিক বিপরীত দিকেই আজকের সংসদ ভবন। তখনকার ঢাকা এমন ঘিঞ্চি ছিলো না। চারিদিকে প্রচুর খালি জায়গা, খেলার মাঠ। আমাদের বাসার পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালেই লাগোয়া বিল্ডিংয়ে ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের দেখা যেতো। আব্বুর সাথে প্রতিদিন ভোরে সংসদ ভবনের সামনের খোলা প্রান্তরে আমি এবং পলি জগিং করতাম। আব্বু দৌঁড়াতো,পেছনে পেছনে আমরা দুই পিচ্চি দৌঁড়াতাম। আব্বু বলতো -- দেখি তো, দেখি তো কে আমাকে প্রথম ছুঁয়ে দিতে পারে। দুইবোন তখন আব্বুকে ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় দৌঁড়াতাম। 


ভোরের আলো ফুটতেই কোয়ার্টারের সামনের গেইটের শিউলি গাছের তলায় পড়ে থাকা শিউলি ফুল কুড়িয়ে এনে বাসায় রেখে আব্বুর সাথে জগিংয়ে যেতাম। বাসায় ফিরে এসে ফুলগুলোর বোঁটা আলাদা করতাম। শুভ্র ফুলগুলো দিয়ে মালা গাঁথতাম। সেই মালা স্কুলের ক্লাস টিচারকে উপহার দিতাম। বোঁটাগুলো রোদে শুকাতাম। পরে সেগুলো গরম পানিতে সেদ্ধ করে রঙ বের করে সেই রঙে পুতুলের সাদা কাপড় সিদ্ধ করে কমলা কালারে রাঙ্গাতাম। এখনকার সময়ে যখন বাটিকের কাজ করি তখন শৈশবের সেই রঙ করার কথা মনে পড়ে যায়। 

আমাদের আত্মীয় স্বজন, দাদী, কাকারা,কাজিনরা সব মিলিয়ে বাসা ভর্তি থাকতো মানুষে।সবার আদরে যত্নেই আমাদের বেড়ে ওঠা।বেশিরভাগ সময় আব্বু বা বড় কাকা মোটরসাইকেলে করে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসতেন। যখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি তখন আমরা বাসা বদল করে হাতিরপুলে চলে গেলাম। আব্বু জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ঔষধের ব্যবসা শুরু করলো। ঢাকার মিটফোর্ডে আমির মেডিসিন মার্কেটে পাইকারি এবং হাতিরপুলে চারটি পাইকারি + খুচরা বিক্রির ঔষধের দোকান ছিল।  

আমি মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতাম। দিনে তো খেতামই কোন কোন রাতে ঘুম ভেঙে মিষ্টির খাওয়ার বায়নায় কান্না জুড়তাম। মিষ্টি না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে কেউ ঘুম পাড়াতে পারতো না। এমনও নাকি হয়েছে, অনেক রাত, বন্ধ দোকান ধাক্কাতে ধাক্কাতে,মিষ্টির দোকানের ভেতরের লোককে ঘুম থেকে জাগিয়ে মিষ্টি কিনে আনতে হয়েছে। মিষ্টি অন্য কেউ চাইতে পারতো না। কেউ চাইলেই কান্না জুড়ে দিতাম। 

হাতিরপুলে প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়ি তখন বাসা ছিল সার্কুলার রোডে। কাছেই হাতিরপুল বাজার। আশেপাশের প্রতিবেশীরা সবাই সবার খুব আপন। হাতিরপুল বাজার থেকে পরিবাগ যেতে একটা পুল ছিল। শুনেছি সেই পুলের উপর দিয়ে হাতি যেতো বলেই জায়গাটার হাতিরপুল নামকরণ হয়েছে। সব বন্ধুরা মিলে কত আনন্দ করতাম, খেলা করতাম। বন্ধুরা মিলে হাঁটতে হাঁটতে হাতিরপুল বাজার পেরিয়ে,পরীবাগ পেরিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত চলে যেতাম। পরীবাগে বিশাল খালি জায়গা ছিল। এখন সেখানে সুউচ্চ অট্টালিকার ভিড়। কত ফুল, ফল সব্জীর চাষ হতো। আমার এক বান্ধবীর পরিবাগের বাসা থেকে আমাদের বাসায় কত ফল পাঠাতো-আম, কাঁঠাল, কদবেল,পেয়ারা আরো অনেকজাতের ফল ! 

স্বনামধন্য গায়িকা পিলু মমতাজের বাবার বাড়ি ছিল হাতিরপুলে আমাদের বাসার খুব কাছেই। উনার ছোটবোন মিতি ফারজানা ইতি ছিল আমাদের বান্ধবী। রুপক আপু,ভদীপক আপু, এ্যানি আপু, লোরা আপু উনাদের বাবা কিংবদন্তী সুরকার, গীতিকার পল্লীগানে নিবেদিতপ্রাণ মমতাজউদ্দিন সকলেই গানের মানুষ। সারাদিন ওই বাসায় গান-বাজনার চর্চা হতো, গানের আসর বসতো।আমি, ইতি, আমার ছোটবোন পলি এবং অন্যান্য বান্ধবীরা মিলে তাদের বাসায় পুতুল খেলতাম। পুতুলের বিয়ে দিতাম। ছাদে পিকনিক করতাম। ইতির বড় আপুরা আমাদের খুব ভালোবাসতো। 

আমরা বন্ধুরা মিলে কুতকুত,টিলো এক্সপ্রেস, কানামাছি,ব্যাডমিন্টন কত খেলাই না খেলতাম। কার বাসার বাচ্চা কার বাসায় আছি এই নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা থাকতো না। আজকের দিনের মতন সামাজিক স্খলন, ব্যভিচার,ধর্ষণ, খুন,ইভ টিজিংয়ের ব্যাপকতা তখন ছিলই না। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দিলেই আমরা যার যার নিজের বাসায় চলে যেতাম। দুপুরবেলা একা একা বাইরে গেলে আম্মু ভয় দেখাতেন -- ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে।  বস্তা হাতে কোন কুড়ানি দেখলেও ভাবতাম -- এই মনে হয় ছেলেধরা। আমাকে বস্তায় পুরে বস্তার মুখ বেঁধে সাথে নিয়ে যাবে। এছাড়া অন্যকিছুতে ভয় পেতাম না। বাজার বাসার কাছে ছিল বলে কতদিন একা একা বাজার থেকে মজা কিনে খেয়েছি। 

আবছা আবছা মনে আছে, তখন আমি খুব ছোট। আমাদের স্কুলে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আসবেন। স্কুলজুড়ে সে কি সাজ সাজ রব!আমরা পরিস্কার স্কুলড্রেস সাথে পরিষ্কার সাদা জুতো মোজা পরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। রাষ্ট্রপতি স্কুলের গেইটে নামতেই "প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ " গানটি মাইকে বাজতে লাগলো। তারপর "এই পদ্মা,এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে, আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায় " -- 

সুরের সুমধুর মূর্ছনায় আবিষ্ট আমরা মোহগ্রস্ত হয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে হাত মিলালাম। সে কি আনন্দ! সে কি উত্তেজনা! একবার কবি শামসুর রহমান কোন এক অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে, আরেকবার বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী আমাদের স্কুলে এসেছিলেন। আমি উনাদের অটোগ্রাফ নিতে পেরে আনন্দে আটখানা হয়েছিলাম। 

ছোটবেলার আমার সেইসব সুন্দর স্মৃতি আজো রোমন্থন করতে আনন্দ পাই। আব্বু আমাকে  সর্বত্র সাথে নিয়ে যেতেন। আব্বুর সাথে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে উনার এক সিনিয়র বন্ধু বিজ্ঞানী ডঃ হাবিবুর রহমানের কোয়ার্টারে যেতাম। তিনি চিরকুমার ছিলেন। ঘরদোর গুছিয়ে রাখতেন না। উনার গবেষণার জিনিসপত্র বাসাজুড়েও ছড়ানো থাকতো। রান্নাবান্না উনার তেমন পছন্দ ছিল না। বেশিরভাগ সময় পাউরুটি খেয়েই কাটিয়ে দিতেন। আমাদের বাসায় ভালো রান্না হলেই উনার দাওয়াত কনফার্ম ছিলো।আব্বুর সাথে বাজারে, বিজনেস প্লেসে, পাবলিক লাইব্রেরিতে, শহীদ মিনারে, রমনা পার্কে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কত জায়গায় না বেড়িয়েছি। আব্বু আমাকে খুব ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী  হিসেবে গড়ে উঠতে অভ্যস্ত করেছেন। 

হাতিরপুল থেকে ভুতের গলিতে বাসা পরিবর্তন করা হলো কারণ তখন আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি। ক্লাস সিক্সে আমাকে মেহেরুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। সেই স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন স্কুল ম্যাগাজিনে প্রথম আমার কবিতা ছাপা হয়। সেই কবিতার শিরোনাম এখন আর মনে নেই। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, বয়স এগার বছর, আমরা ঢাকা ছেড়ে গাজীপুর চলে গিয়েছিলাম। গাজীপুরের জয়দেবপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই এসএসসি পাশ করি। আমাদের বাসা ছিল দক্ষিণ ছায়াবীথিতে। তখনো আমার শৈশব, আমি সাড়া পাড়ার সবার প্রিয় ডলি হয়ে উঠি। পাড়ার চাচীরা,খালাম্মারা,বড় আপুরা সবাই খুব স্নেহ করতেন। স্কুলে কম বয়সে উচ্চ শ্রেণীতে পড়ার কারণে ক্লাসমেটসহ অনেক শিক্ষকদের কাছে আদরের পিচ্চি ডাকেই পরিচিত ছিলাম। কলেজে হাতে গোনা দুইতিন জন ছাড়া স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের আপুরাই কলেজের সহপাঠী ছিল এবং তারাই ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কলেজে পড়াকালীন সময়েও আমাকে অনেকেই পিচ্চি বলে ডাকতো যদিও তখন আমি লম্বায় পাঁচ ফুল সাড়ে চার ইঞ্চি উচ্চতার ডলি। 

শৈশবের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি শবেবরাত এবং দুটো ঈদকে ঘিরে। শবেবরাত ঢাকাতে থাকতে ঢাকাতেই এবং গাজীপুর চলে যাওয়ার পর থেকে গাজীপুরেই করতাম। সারাদিন আম্মু এবং বাসার বড়রা মিলে রুটি এবং নানা-পদের হালুয়া তৈরি করতেন। আমরা বাসায় আসা মিসকিনদের মাঝে সেগুলো বিতরণ করে খুব মজা পেতাম। রাস্তায় যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম কখন নতুন মিসকিনের দেখা মিলবে। প্রতিবেশীদের বাসায় বাসায় রুটি-হালুয়া দিয়ে আসতাম। তারাও তেমনি করে নিয়ে আসতো। অন্যদিন শুধু ফ্রক পরলেও সেদিন জামার সাথে সালোয়ার ওড়না পরতাম। তারাবাতি জ্বালাতাম,বাজি ফোটাতাম। ছোট ছোট বান্ধবীরা একসাথে নামায পড়তাম,কায়দা- সিপারা পড়তাম। সেইরাতে কখন কার বাসার নামাযের পাটিতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়তাম তা নিজেও বুঝতে পারতাম না। 

ঈদেগুলো আমরা গ্রামের বাড়িতেই করতাম। ঈদের আগে স্কুল বন্ধ দিলে অথবা আব্বুর বিজনেসগুলোতে ঈদের ছুটি শুরু হলেই আমরা কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে ট্রেনে আখাউড়া জংশন স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতাম। তখনকার সময় ইন্টারসিটি ট্রেন সার্ভিস ছিল না। ট্রেনের সংখ্যাও এখনকার মতন এতবেশি ছিল না। তাই ঈদের মৌসুমে ট্রেনে এখনকার মতনই খুব ভিড় হতো। বর্তমান সময়ে প্রচুর ট্রেন আছে কিন্তু যাত্রীর আধিক্যের কারণে ভীড় কমছে না।ডক থেকে ট্রেন ষ্টেশনে এসে থামতেই কাকারা বা চাচাত, ফুফাতো ভাইয়ারা ট্রেনে চড়ে পেপার বিছিয়ে বা মালামাল রেখে বসার জায়গা দখল করতেন। ভিড়ে আমাদের জানালা গলিয়ে ট্রেনের কামড়ায় প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হতো। আমি খুব মজা পেতাম। এত রোমাঞ্চিত থাকতাম যে জোর করেও আমাকে সিটে বসানো যেতো না। ট্রেনের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরের সব দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতাম। ট্রেনের চলার শব্দের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে কুঁ ঝিক ঝিক কুঁ ঝিক ঝিক ছড়া আওড়াতাম।

আখাউড়া ষ্টেশনে নেমে আমরা রিকশায় চড়তাম। সেই রিকশা থেকে গঙ্গাসাগর এলাকার মোগড়া বাজারে নেমে বাকি একমাইল প্রশস্ত কিংবা সরু কাঁচাপথ হেঁটেই যেতাম। রাস্তার পাশে  পড়তো বেশ কয়েকটা বিশাল বিশাল বট গাছ। সেই গাছগুলোর শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতো। ক্লান্ত হলেই বটগাছের নিচে জিরিয়ে নিতাম। ছোট ছোট বোনদের বড়রা কোলে বা কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যেত কিন্তু আমাকে হাঁটতে হতো। দূরে রেললাইন দেখা যেত। শ্মশান দেখা যেত আর দেখা যেত দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। দৌড়ে বটগাছগুলোর ছায়ায় থাকা ছোট দোকানঘরের বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিতাম। রাস্তা দিয়ে যাওয়া সবাই আব্বুকে চিনত। তারা সালাম বিনিময় করে কথা বলতো। 

বাড়িতে পৌঁছাতেই আমাদের আনন্দ মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। কারণ ঈদ উপলক্ষে বাড়ির বাইরে বিভিন্ন শহরে থাকা আত্মীয়, অন্যান্য কাজিনরাও বাড়িতে আসতো।সবার সাথে সবার দেখা হতো, আড্ডা, খেলা, গল্পে জমজমাট তখন পুরো বাড়ি। আমাদের প্রিয় বুবু রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতেন - আমরা কখন বাড়িতে প্রবেশ করবো। আমাদের জড়িয়ে ধরে আদরে চুমুতে ভরিয়ে দিতেন। নিজেদের গাছের পাকা কলা,পাকা আম,বরই যখন যে ফলের সিজন থাকতো তাই আমাদের জন্য রেখে দিতেন। গাছের পাকা পেঁপে,কচি শশা, পেয়ারাগুলো যেন অন্য কেউ পেড়ে নিয়ে না যায় সেদিকে ছিল বুবুর সতর্ক দৃষ্টি। রাতে বুবুর কাছে ঘুমালে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিত। বুবু এখন পরপারে।বুবু কি বুঝতে পারে আমি আমার প্রাণপ্রিয় বুবুকে কতটা মিস করি। সাঁতার না জানা থাকলেও নিজেদের বিরাট পুকুরে নেমে যেতাম। পুকুরের কিনারা ঘেঁষে গামছা দিয়ে মাছ ধরতে চেষ্টা করতাম।পুকুরের বেশি গভীরে যাওয়ার সাহস হতো না। ডুব দিতে ভয় পেতাম বলে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে ঘড়া ভরে পানি নিয়ে মাথায় ঢালতাম। ফুপুরা আমাকে সাঁতার কাটা শেখাতে কত চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার সাঁতার শেখা হয় নি।আমার দুই বছরের বড় চাচাতো ভাই ছিল আবুল বাশার ভাইয়া। আমি ভাইয়াকে তুই করে বলি। ভাইয়ার সাথে পুরো গ্রামে যেখানে সেখানে অবাধ ঘুরাঘুরি করতাম। এখনো কি কাজিন ভাই-বোনদের মাঝে সেইরকম সখ্য আছে? 

বিবাহিত ফুপুরা শ্বশুরবাড়ি থেকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতেন।কত পিঠাপুলি, হাতের সেমাই তৈরি, মেশিনের সেমাই, ফিরনি রান্না নিয়ে বুবু,আম্মু,চাচীরা ব্যস্ত থাকতেন। নিজের জমির ধানের পোলাও, বিন্নি, ঘরে পালা মুরগী,খাসি দিয়ে ভোজের ব্যবস্থা হতো। কুরবানির গরু হাট থেকেই কেনা হতো। কখন কোন ঘরে খাচ্ছি আর কোন ঘরে ঘুমাচ্ছি তার ঠিক থাকতো না। 

সেইসব মধুর দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। দাদা-দাদু, নানা- নানুর কোলেপিঠে চড়া,মামাদের সাথে জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে খেলা। মামাদের সাথে সাইকেল চড়া, গ্রামের মেলায় যেয়ে মাটির পুতুল, খেলনা,চুড়ি,ফিতা, সন্দেশ,কদমা,বাতাসা,চিনি বা গুড়ের মঠ কেনার আনন্দ আর কোনদিন পাবো না। ঘরের ভাজা মুড়ি,খই,চিড়ার দেখাও আর মিলবে না।নানুদের জমির আখ থেকে রস বের করে লালি , তালের আঁটি পেরে শ্বাস বের করে খাওয়া কিংবা সারারাত জেগে চাঁদনী রাতের গানের আসরে মেহেদীতে হাত রাঙানো কেবলই শৈশব স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। আমার নানু খুব সুন্দর গান করতেন। তিনি এখনো সুস্থ আছেন।তবে তার অধিকাংশ সময় কাটে নামায পড়ে এবং কোরআন তেলাওয়াত করে। 

স্মৃতির ঝাঁপি খুললে তার মুখ আটকানো খুব কঠিন ব্যাপার। শৈশবের নানা রঙের দিনগুলো ভুলা যায় না। তারা আমাকে পিছু ডাকে। কিন্তু হায়!যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে আনা যায়! আমাদের সন্তানরা তাদের শৈশবে সেইসব আনন্দের ছিটেফোঁটাও কোনদিন পায়নি। তাদের জন্য দু:খ হয়। জীবনের অনেক উজ্জ্বল রঙ দেখার সৌভাগ্য থেকে তারা বঞ্চিতই থেকে গেলো। 

"পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়

ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভুলা যায়! "