সুচিন্তিত মনভাবেই হোক হতাশা দূরীকরণের মূল হাতিয়ার

সুচিন্তিত মনভাবেই হোক হতাশা দূরীকরণের মূল হাতিয়ার

উম্মে হাবীবা আফরোজা

  

"হতাশা" বর্তমান যুগের বহু আলোচিত একটি বিষয়। ভার্চুয়াল ও বাস্তব জীবনে কম বেশি সবাই এই রোগে  জর্জরিত। এই হতাশা থেকে  বাঁচার অভিপ্রায়ে আত্মহননের মত  পথ বেছে  নিচ্ছেন অনেক হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা।

কেউ বা আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত জীবনে। যা ধীরে ধীরে সর্ব শান্ত করছে যুব সমাজকে। এই হতাশার মূলে রয়েছে ব্যর্থতা।  হতাশা ও ব্যর্থতার শ্রেণি বিন্যাস করলে বিষয়টি অনেকটা এমন হয়___ প্রত্যাশা __>অপ্রাপ্তি__>হতাশা___>আত্মহনন।

ব্যর্থতা ছাড়া সাফল্য অবান্তর। এই ব্যর্থতায় হতাশার মূল।কিন্তু এই ব্যর্থতা থেকে সর্বোত্তম শিক্ষা নেয় মানব মস্তিষ্ক। ব্যর্থতা মূলত এমন একটি বিষয় যা চলার পথে স্বাভাবিকভাবেই আসতেই পারে।আর একে সামলে ওঠাও একটি শেখার বিষয়।ভুল করলে এ শিক্ষা আপনি পেয়ে যাবেন।আর পরবর্তী সময়ে যেন এমন ভুল না হয়, সে উদ্যমও এ থেকে সঞ্চয় করা সম্ভব হবে। 

জীবনে সফল হওয়ার অর্থ কী?

আমরা মানুষরা বর্তমানে প্রতিযোগিতা করে থাকি একে অন্যের সঙ্গে, কে কার থেকে বেশি সম্পদশালী হবো।কারন জীবনে সফল হওয়ার মানে বলতে আমরা বুঝি থাকি সেটেলমেন্ট, টাকা,ক্ষমতা,সম্পদ ইত্যাদি অর্জন করা।আবার অনেকে মনে করেন শুধু টাকা নয় শিক্ষিত হওয়াও সম্মান এর পাত্র হওয়াও সফলতার অংশ বটে।

তাই সবাই সারাজীবন এসবের পিছনে ছুটছে তো ছুটছে সফলতা অর্জনে।আমরা ভুলে যায় মানুষ বাঁচবে স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। বেঁচে থাকবে তার পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। 

মনোবিজ্ঞানে হতাশাকে নেতিবাচক আবেগ বলা হয়, শুধু মনোবিজ্ঞানেই নয় রাসূল (স) বলেছেন__" হতাশ
 হওয়া কুফরী"।

হতাশা কাকে বলে?
মানুষ যা আশা করে বা স্বপ্ন দেখে তা যদি না ঘটে বা না পায় তখন মানুষের যে নেতিবাচক মানসিক অবস্থা হয় তাকে হতাশা বলে।

ভবিষ্যতের আশঙ্কায় অধীর হওয়া ধর্মকে অবজ্ঞা করার মতো। এ পৃথিবীর বহু লোকেই ভবিষ্যৎ ক্ষুধা,দরিদ্র, পীড়া ও দুর্যোগ ভয়ে অযৌক্তিক ভাবে ভীত। এ ধরনের চিন্তা ভাবনা শয়তানের ধোঁকা মাত্র।

"শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় ও অশ্লীল কাজ করার আদেশ করে অথচ সৃষ্টিকর্তা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। (সূরা আল বাকারা -২৬৮)

জীবনে কোন কিছু চিরস্থায়ী নয়,দুঃখও নয়।রাতের পর যেমন দিনের আগমন অবধারিত তেমনি দুঃখের পর সুখের আগমনও অবধারিত।

ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ নেই এতে বরং হতাশা বাড়বে বৈকি কমবে না। কারন ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্তার হাতে।

" সৃষ্টিকর্তার আদেশ আসবেই, সুতরাং তোমরা এর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড় না"।(সূরা আন _নাহল-১১)

"নিশ্চয় যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদের জন্য তিনিই যথেষ্ট।" (আল_কোরআন)

আপনি যা পাচ্ছেন সে তো আল্লাহর একান্ত দান,তিনি যা দিচ্ছেন তা আপনার জন্যই নির্ধারিত। তিনি যা থেকে আপনাকে বঞ্চিত করেছেন তা আপনি কিছুতেই পেতেন না।
ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এই পৃথিবীর অন্যায়-অত্যাচার অশ্লীলতার নৈরাজ্যের ভিড়ে আমরা যেনো সত্য ও সুন্দরের আশা থেকে ছিটকে না যাই।পৃথিবীতে ভালোবাসার বড্ড অকাল। কুৎসা,নোংরামি,পরনিন্দা, কুধারনা,কূটনামিতা ভরে গেছে নাগরিক মন।

আমাদের উচিত এসব নোংরা চরিত্রের নেগেটিভ চরিত্রের সঙ্গ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা।যারা আমাদের তুচ্ছ জ্ঞান করে, নানা ভাবে প্রলোভনে পেলে হতাশা গ্রস্ত করে তোলে তাদের থেকে যোজন যোজন দূরত্ব বজায় রাখা।
আপনি যখন অসার, নিরর্থক কথাবার্তা বলা,কুচিন্তা করা মানুষদের সঙ্গে চলতে থাকবেন আপনার মন মানসিকতার ধরনও সেই পর্যায়ে পরিণত হতে বাধ্য।

একমাত্র ভালোবাসাময় পৃথিবীই পারে যে কোনো সুন্দর পরিবর্তন করতে।এই সমাজের কিছু মানুষ আছে যারা আপনাকে আঙ্গুল তোলে বোঝানোর চেষ্টা করে যাবে আপনি যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে আপনি ভালো নেই,ভালো থাকলেও আপনাকে সেই বুঝিয়ে ছাড়বে, আপনি ব্যর্থ।আপনি নিঃস্ব, আপনার সফলতা বলতে কিছু নেই। এই সমাজ আমাদের জ্ঞান যতটুকু দেয় তার বদলে যদি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতো তাহলে ব্যর্থতা বলে মানুষের জীবনে আর কিছুই থাকতো না।আর আমরা কিছু নির্বোধ মানুষেরা এসব কান জ্বালানো কথার স্বীকার হয়ে নিজেকে অন্যের কাছে ভালো আছি বোঝাতে শান্তি বিসর্জন দিয়ে, নিজস্ব চাহিদা বিসর্জন দিয়ে, জীবন যুদ্ধ করতে করতে একসময় না পারলে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বিশ্বাস করুন এই পরিস্থিতিতে আপনি কেবল আপনার সঙ্গী হবেন সেইসময় জ্ঞান দেওয়া মানুষ গুলোকে আর পাশেও পাবেন না।আমরা ভুলে যাই, জীবন আমাদের, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আমাদের। আমরা যে অবস্থানে আছি তাতে যে প্রশান্তিটুকু আছে তা হয়তো তাদের রাজ প্রাসাদেও নেই। আমরা ভুলে যাই সুখের চেয়ে শান্তি অনেক দামি, অনেক বড়।

আমরা কেউ যার যার অবস্থানে সন্তুষ্ট নয়, আর একারনে উৎপত্তি হয় এতো হতাশার। 
একজন বেকার ছেলের হতাশা তার জব নেই কিন্তু আরাম ও শান্তি আছে। আবার সারাদিন কর্মব্যস্ত ছেলেরও দিন শেষে হতাশা নিজের জন্য আলাদা কোনো সময় নেই। ছুটছে তো ছুটছে সবাই লাগামহীন ঘোড়ার মতো। কেউ বিশ্রামের আশায় হতাশায় ভুগছে কেউ বা কর্মের অভাবে।
বিবাহিত দম্পতিদের মনেও শান্তি নাই,
এই যেনো একই ছাদের নিচে সমাজের দায়ে পরে নামমাত্র সংসার করা,যেখানে আন্তরিকতা নেই, সুসম্পর্ক নেই, নেই হৃদিক ভালোবাসার সম্পর্ক।কিন্তু তাদের লোক দেখানো ভার্চুয়াল জগতে কাপল ছবি দেখে আমরা বাগ বিচারহীন বলে দিই যে কী   সুখী  না এই দম্পতি!

আমরা বুঝি একাকিত্ব মানে একা থাকাতে অথচ হাজারো মানুষের ভিড়ে যে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে সত্যি কারে সেই একা।সুখের চেয়ে শান্তি বড় এই কথাটা কয়জনেই বা বুঝে!?
জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নিয়ন্ত্রিত হই আবেগ দ্বারা। এই আবেগ থেকে সূত্রপাত ঘটে অধিকাংশ সমস্যা। 

ড্যানিয়েল গোলম্যান_ এর তাঁর ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স তত্ত্বে বলা হয় ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ব্যক্তিরা সমালোচনা গ্রহন করতে সক্ষম।  তারা সমালোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।

এতে তারা আত্ম সচেতন হয়।কে আপনাকে নিয়ে কী কী বললো তার চেয়ে বড় কথা আপনি আদৌ সেই ধরনের মানুষ কিনা।নিজেকে প্রশ্ন করুন! নিজেকে জানার চেষ্টা করুন
যদি নেতিবাচক কিছু থাকে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজুন,অন্যথায় নিন্দুকের কথায় হতাশা গ্রস্থ না হয়ে ইগনোর করতে শিখুন।

লোভ,হিংসা ও অহংকার বোধও আমাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে।

রাসূল্লাহ (স) --"লোভ লালসাকে দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রনার উপকরণ বলে উল্লেখ করে বলেছেন__"বিশ্বাস ও লোভ এক অন্তরে একত্র হতে পারে না,এর কারন অত্যন্ত সুস্পষ্ট কেননা, বিশ্বাসের পরিণাম হচ্ছে ধৈর্য, সহনশীলতা  ও অল্পে তুষ্ট থাকা।লোভ লালসার পরিণাম অশান্তি ধৈর্যহীনতা ও অস্বস্তিবোধ।( নাসায়ী ও তিরমিজি) 

 সৃষ্টিকর্তা কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় সর্তকতা তুলে ধরেছেন__" তোমরা জেনে রেখো,পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া কৌতুক,জাঁকজমক, পারস্পরিক গর্ব প্রকাশ,  ধন সম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছু নয়।এর উপমা হলো বৃষ্টি,যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য ভান্ডার কৃষকদের চমৎকৃত করে তারপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। অবশেষে তা খড় কুটায় পরিণত হয়। অনন্তকালের রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পৃথিবীর জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। 
(সূরা- আল হাদিদ_২০)

দুর্যোগ মানেই জীবন ধ্বংস নয়, হোক তা প্রাকৃতিক কিংবা মানব সৃষ্ট।দুর্যোগ কেটে যাবে।সহজ করে গ্রহণ করুন জীবন।হাসিমুখ থাকুন,কাজের মাঝে বেঁচে থাকুন, যেন সেগুলো সাদকায়ে জারিয়ে হয়ে মরনের পরও বন্ধু হয়ে রয়।কিছুটা সময় নিজেকে দিন।
ভাবুন___

** কেন আমার এই জীবন?
** কেন এসেছি পৃথিবীতে? 
** আমি ঠিক কী চাই এই জীবন থেকে?
** আমি যা করছি তা কেন করছি?
**আমি যা করছি তা কী সত্যি আমি চাই?.
** আমি যা চাই তা পেলে কী আমি সফল হবো?
**আমার সফলতার মানদন্ড কে ঠিক করে দিচ্ছে? 
**জীবনের শেষ দিন কী পেলে নিজেকে সফল মনে করবো?.

মানুষের জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি থাকবেই। চাওয়ার শেষ নেই,দুনিয়ার জন্য যেসব সম্পর্ক  সেগুলোও ভেঙ্গে যাবে _ কেননা মানুষ  এখানে থাকবেই অল্প সময়ের জন্য।  এখানে সুখ খোঁজা বোকামি।বরং শান্তিই শ্রেয়। আপনার শান্তি কোথায়,প্রশান্তি কিসে,সেখানে অবস্থান করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দিনশেষে একটা মানুষের পরম প্রাপ্তিটাই হলো প্রশান্ত চিত্ত।

কতো শত ধ্যানী-জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, নেতা, বিপ্লবী, দার্শনিক দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, তাদের কেবল আমরা স্মরণসভায় স্মরণ করি কিছুকাল, এক সময় কেউ আর মনে রাখে না।আমরা সবাই কালের স্রোতে বিস্মৃত হয়ে যাবো।

এই হতাশার পীড়া থেকে বাঁচতে আপনাকে অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।নিজেকে ভালোবাসুন,নিজের প্রশান্তির জন্য বাচুঁন, স্রষ্টার আনুগত্যের জন্য বাঁচুন,পজিটিভ চিন্তা করুন, আর বিশ্বাস করুন যে ব্যক্তি অন্যের উপকারে ব্রত থাকে তার মতো সফল পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।কারো উপকার করার মত তৃপ্তি দুনিয়ার আর কিছুতেই নয়।আত্ম সম্মানবোধে বাঁচুন।
সুচিন্তিত মনোভাবেই হোক হতাশা দূরীকরণের মূল হাতিয়ার। 
সুস্থতায় বাঁচুক সকল প্রাণ।