স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণুর অবদান
মো. আব্দুল মালিক
কবি বলেছেন, -
‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী।
রানীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে, রাজ্যের যত গ্লানি।’
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আক্ষরিক অর্থে বাংলার রাজা না হলেও তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির মুকুটহীন সম্রাট। শেখ মুজিবুর রহমান একদিনে বঙ্গবন্ধু বা জাতির জনক বা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন নাই। তিনি ধাপে ধাপে খ্যাতির এই শীর্ষে আরোহন করেছেন। আর এই শীর্ষে আরোহণের পিছনে যে মানুষটি তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন, আগলে রেখেছেন, সাহস যোগিয়েছেন, উৎসাহ-উদ্দীপনা, বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছেন, নিজের জীবনের সুখ সাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে আর্থিক সাহায্য করেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তাঁর ডাক নাম রেণু। তিনি ৮ আগস্ট ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গোপালগঞ্জ জেলার টুংগিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ জহুরুল হক,মাতার নাম হোসনে আরা বেগম, দাদার নাম শেখ কাশেম। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপন চাচাতো বোন। পিতা-মাতা মারা যাওয়ায় দাদা শেখ কাশেম তাঁর দুই নাতনি ফজিলাতুন নেছা ও জিন্নাতুন নেছাকে দুই ভাতিজার সাথে বাল্য বিয়ে দেন। তখন ফজিলাতুন নেছার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। পাঁচ বৎসর বয়সে ফজিলাতুন নেছা রেণু আসেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা ভবিষ্যৎ পুত্রবধু ফজিলাতুন নেছাকে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহধর্মিনী হিসেবে গড়ে তুলতে থাকেন। তাঁদের সেই পরিশ্রম বৃথা যায় নি। বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায়ই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন প্রথম জেলে যান এবং মাত্র ৫৫ বছর ০৪ মাস ২৭ দিন জীবনের মধ্যে প্রায় ৮ বছর ৫ মাস ২৩ দিন জেলে ছিলেন। এই জেল জীবনে বঙ্গবন্ধুর খোঁজ খবর নেয়া, তাঁকে জেল থেকে বের করে আনা,আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা, পরামর্শ দেয়া, নেতাকর্মীরা জেলে গেলে তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেয়া সর্বোপরি নিজের পরিবার সামলানো- এ ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এবং জীবন ছিল ভীষণ দূর্বিসহ । তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে রাজি হতো না পুলিশের ভয়ে,দিলেও কিছুদিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে হতো। আত্মীয় স্বজনরা পর্যন্ত সম্পর্ক রাখতে চাইতো না পাছে সরকারের রোষানলে পড়তে হয় এই ভয়ে। কিন্তু বঙ্গমাতা এতো সব সমস্যার মধ্যেও কখনো ভেঙ্গে পড়েন নি, হতাশ হন নি বা বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে যান নি। বিশ্বের ইতিহাসে এমন নির্যাতিত-নিপীড়িত নেতার স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছেন এমন নজিরও আছে। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব তাঁর ছেলেমেয়েদের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, আত্মীয় স্বজন, নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর রেখেছেন। তাদের বিপদে আপদে এগিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে বের করার জন্য বারবার আদালতে ও আইনজীবীর চেম্বারে গেছেন কিন্তু কখনো স্বামীর মুক্তির জন্য স্বৈরাচারী সরকারের সাথে, অপশক্তির সাথে আপোষ করেন নি।
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনে ভীত হয়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার তাঁকে ফাঁসি কাষ্টে ঝোলানোর জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পুরে। এদিকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা নেতাকর্মীদের নিয়ে এমন তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলেন যার ফলে সরকার বাধ্য হয় বিরোধী দলীয় নেতাদের সাথে গোলটেবিল আলোচনায় বসতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া সেই গোলটেবিল বৈঠক অর্থহীন হবে বিধায় আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চান। এদিকে আওয়ামীলীগের প্রথম সারির নেতারাও বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির জন্য রাজি। কিন্তু বাদ সাধলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে যান জেলে। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তিনি জানতে চান, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসতেছেন কি না ? বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেই নি। তখন বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলেন,- “তুমি মুক্তি পেলে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী খুশি হবো আমি। কিন্তু আমি বলছি তুমি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে জেল থেকে বের হবে না। সরকার যদি তোমাকে বেকসুর খালাস দেয় তো বের হবে, নতুবা বের হবে না এটা আমার সাফ কথা।” বঙ্গবন্ধু তাঁর কথায় রাজি হলেন, তিনি প্যারোলে মুক্তি নিলেন না। পরে সরকার বাধ্য হয়ে তাঁকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি দেয় এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টনের বিরাট জনসভায় ছাত্রনেতারা তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে জেল থেকে বের হতেন তাহলে হয়তো তিনি জীবনে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হতে পারতেন না।
সত্তরের নির্বাচনের পর পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল বাহানা শুরু করে তখন শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী বক্তব্য রাখবেন। এ নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানে টান টান উত্তেজনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বঙ্গবন্ধুকে বলে দেয়া হয়েছে, তিনি যেন স্বাধীনতা ঘোষনা না করেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী বোমারু বিমান নিয়ে,সেনাবাহিনী কামান নিয়ে প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই রেসকোর্স ময়দানেই হামলা করবে। এদিকে বাঙালি জাতি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন, বঙ্গবন্ধু কখন আসবেন, কখন স্বাধীনতার ঘোষনা দিবেন। ৭ই মার্চের আগ থেকেই অনেক নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, বিরোধীদলীয় নেতা বিশেষ করে ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিচ্ছেন, চাপ দিয়ে যাচ্ছেন- বঙ্গবন্ধু যেন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অন্যদিকে বয়স্ক, মধ্যপন্থী নেতারা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘোষণার বিপক্ষে। এই সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন উভয় সংকটে। রেসকোর্স ময়দানে যাবার আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর বেড রুমে গেলেন,তাঁর সহধর্মিনী, দুঃখ সময়ের বন্ধু, সাহস ও পরামর্শ দাতা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার কাছে। বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলেন,“তোমাকে কে কী বলল, সে সবে তুমি কান দিও না, তুমি যা ভালো মনে কর তাই বলবে। মনে রাখবে ইয়াহিয়ার বাহিনী প্রস্তুত হয়ে আছে তোমার বক্তব্যের পর পরই বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।” বঙ্গমাতার এই সতর্ক বাণী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে সংকটময় মুহুর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় যে সাহায্য করেছিল তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে অতি সতর্কতার সহিত বাঙালি জাতিকে পূর্ণ পরিস্থিতি বর্ণনা করলেন, পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা দিলেন এবং কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণাও দেন। অথচ পাকিস্তান সরকার বা তাদের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা ঘোষনার জন্য দায়ী করতে পারলো না, বাঙালি জাতির উপর ঐ মুহর্তে আক্রমণ করতে পারলো না। অঅন্যদিকে বাঙালি জাতির দুপক্ষই খুশি হলেন। বিধির লিখন না যায় খন্ডন। পাকিস্তানী হায়েনারা ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি জাতির উপর অতর্কিত আক্রমণ করে বসে। তবে সেই আক্রমণে পাকিস্তানীরা বিশ্ববাসীর নিকট আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়, বঙ্গবন্ধু বা বাঙালিকে দোষ দিতে পারে নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একশত ভাষণের মধ্যে প্রথম দশে অবস্থান করছে এবং অলিখিত ভাষণের মধ্যে প্রথম স্থানে আছে। এই ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভূক্ত হয়ে বাঙালি জাতির গৌরব বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। একসময় এই ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে পরিগনিত হবে। কারণ বঙ্গবন্ধু যে ত্রিশংকুল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই ভাষণ দিয়েছিলেন এরকম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আর কেউ বক্তব্য রাখেন নি। এই ভাষণের পিছনে বঙ্গমাতার অবদান অনস্বীকার্য।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখে। সেখানে সামরিক আদালতে বিচার করে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। উক্ত কারাগারে তাঁর জন্য কবরও খুড়েঁ রাখা হয়। আর এদিকে বঙ্গমাতা সন্তানদের নিয়ে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি আশ্রয় নিতে থাকেন। পরে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁদের গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮নং রোডের ১টি বাড়িতে বন্দী করে রাখে। এই বন্দী জীবনেও তাঁকে দুঃসহ দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তারপরও তিনি ধৈর্য হারান নি। একদিকে হাসপাতালে অসুস্থ শয্যাশায়ী শ্বশুড়-শাশুড়ির সেবা করা, সন্তানদের দেখাশোনা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জৈষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জয়ের জন্ম ,পাকিস্তানী সৈন্যদের গঞ্জনা শোনা, অপরদিকে স্বামী ও দু’পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামালের চিন্তায় নিমগ্ন- এই সময় তাঁকে একটা অমানষিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের বন্দী অবস্থায় যেকোনো মুহুর্তে তাঁর মৃত্যু ছিল অনিবার্য। এভাবে বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা রেনু শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু,হালের বিশ্ববন্ধু, জাতির জনক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হতে অবদান রেখেছিলেন।
আবারো কবির ভাষায় বলতে হয়:
‘এ বিশ্বে যাহা কিছু মহিয়ান চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
কবির কবিতার সূত্র ধরে বলতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অবদান রেখেছিলেন তাঁর অর্ধেকের দাবীদার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এই মহীয়সী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাসের গবেষকরা একদিন নিশ্চয়ই যথাযথভাবে বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মূল্যায়ন জাতির সামনে তুলে ধরবেন। এই মহিয়সী নারীর ৯৪তম জন্মদিনে এই প্রত্যাশা রইল। এই আগস্ট মাসের ৮ তারিখে তাঁর জন্ম এবং ১৫ তারিখে কতিপয় বিপথগামী কুলাংগারদের হাতে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন।
পরিশেষে ১৫ই আগস্টের সকল শহীদানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শেষ করছি।