একটি সত্যি গল্প

একটি সত্যি গল্প
 গোলাম কবির 
মৃত্যু তো অনেক দেখলাম, অন্য লোকের, 
নিজের মৃত্যু কি কেউ দেখেছি? 
একটু কল্পনা করে দেখি তো -
কেমন হয় নিজের মৃত্যুটা। 
চোখ দুটো বন্ধ করে চিন্তা করি, 
আমি এখন কোনো এক এ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে শোয়া আছি, আমার পাশে স্ত্রী, 
পুত্র, কন্যা ক্রন্দনরত, হাসপাতালের লোকজন সঙ্গে আর আছে নাকে নল লাগানো অক্সিজেন সহ  সিলিন্ডার। এভাবেই শহরের ব্যস্ততম রাস্তা দিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে চললো গাড়ি
অনন্তের দিকে। একসময় হাসপাতাল যাবার পথেই মহান সৃষ্টিকর্তার দূত এসে তাগাদা দিলো নিয়ে যাবার জন্য, 
আমি বিড়বিড় করে কালিমা পড়ছি, 
এক সময় চোখ বন্ধ হয়ে আসলো, 
ঠোঁটও আর নড়ে না, শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো 
এবং দেহটা নিথর হয়ে পড়ে রইলো। 
দৃশ্যটা হঠাৎই নজরে আসায় প্রিয় কন্যা সন্তান বাবা! বাবা! বাবা!
বলে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো এবং তা সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের মাঝেও সংক্রামিত।   তারপরও শেষ আশা মানুষ ছাড়ে না, 
তাই হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো হলো 
এবং ডাক্তাররা পরীক্ষা করে গম্ভীরমুখে 
আমাকে মৃত ঘোষণা করলেন। 
ছেলেটা চোখ মুছতে মুছতে ক্রন্দনরত অবস্থায় বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনকে ফোন করছে এই মৃত্যুর নির্মম অমোঘ ঘোষণার। 
তারপর আমাকে নিয়ে আনা হলো বাসায়! 
না, না, বাসায় মানে নিজ গৃহে নয়, 
এটা বাসার গ্যারেজ! 
আগে থেকেই বলে রাখা ছিলো বলে মসজিদের লাশের খাটিয়ায় অনেকে ধরাধরি করে আস্তে করে আমাকে রেখে দিলো। বাসার ভিতরে তখন তুমুল কান্নার 
রোল পড়ে গেলো। মা এসে আমার লাশের সামনে কাঁদছেন আর প্রলাপ বকছেন নানা 
রকম অতীত স্মৃতিচারণ করে। এরই মধ্যে
কেউ একজন এসে মাকে ধরে সরিয়ে নিল। 
বাবা তো সেই কবেই চলে গেছেন, 
তাই আর তাঁর কথা বললাম না। 
এরপর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন সহ অন্যান্য নিকট আত্মীয়রা এসে একটু কান্নাকাটি করলেন!  
এরপর আস্তে আস্তে গল্পটা জমে উঠলো। 
আমি কেমন মানুষ ছিলাম, কেউ কেউ 
এ বিষয়ে অশ্রুসজল স্মৃতি আওড়ালো। 
একজন ছেলেটাকে কাছে বসিয়ে প্রবোধ দেবার ও পরবর্তীতে কিভাবে চলবে  
এই বিষয়ে একটা নসিহত মূলক বক্তব্য 
দিয়ে ফেললো। এরই মধ্যে কেউ কেউ
চলে গেলো লাশের গোসল এবং 
কাফনের সরঞ্জামাদি কিনে আনতে। 
সময় যে আর কাটে না, এদিকে আমি কিন্তু ততক্ষণে জায়গা মত চলে গেছি। 
পড়ে আছে শুধু আমার দেহের খাঁচা, 
পরানপাখি তখন উড়াল দিয়েছে। 
এদিকে মসজিদের মাইকে 
" একটি শোক সংবাদ! " বলে -
আমার মৃত্যু সংবাদ, নাম ঠিকানা, 
বয়স ইত্যাদি উল্লেখ সহ জানাজার সময় ঘোষণা করা  হলো। 
ফেসবুক, খবরের  কাগজ ও অন্যান্য  মাধ্যমে ও হয়তো বা কেউ কেউ এই নিয়ে 
সংবাদ প্রচার করলো ছবি সহ। 
এরমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল কোথায় 
আমাকে দাফন করা হবে এই বিষয়ে। 
যথারীতি লাশের গোসল হয়ে গেলো দ্রুতই। 
এখন আবার শিথিল শরীরটা টেনে নিয়ে 
সবাই মিলে কাঁধে তুলে বদলাবদলি করে নিলো আমার ভারী লাশ, 
সঙ্গে পড়তে লাগলো কালিমা শাহাদাত। তারপর লাশটা মসজিদের মাঠের একটা কোণে ফেলে রেখে সবাই ওয়াক্তের নামাজ পড়লো, এরই মধ্যে আবার কেউ কেউ এসে পৌঁছেনি বলে তাদের জন্য একটু অপেক্ষা করে জানাজার জন্য সবাই লাইনে 
এসে দাঁড়ালো। ছোটো ভাইটা আমার জন্য 
সবার কাছে আমার এই নাতিদীর্ঘ জীবনে  
কারো সাথে কোনো অন্যায় আচরণ করলে বা কারো মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে তার জন্য মাফ চেয়ে নিলো, 
আবার কেউ যদি আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা পায় তবে জানাতে বললো এবং 
যথা সম্ভব দ্রুত পরিশোধের আশ্বাস দিলো। 
তারপর ইমাম সাহেব জানাজা পড়ালেন। 
এরপর কেউ কেউ চলে গেলো যার যার মতো, কেউ আবার আমার লাশের সাথে দাফন করার জন্য সাথেই চললো, 
অশ্রুসজল। তারপর আমাকে
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে শোয়ানোর জন্য নামানো হলো খাটিয়া হতে, 
খুব নিকট জনেরা নামলো কবরে শোয়ানোর জন্য। 
এদের মধ্যে কেউ একজন আমার লাশের 
মুখটা ঘুরিয়ে দিলো নিয়মানুযায়ী। 
তারপর পিনপতন নিরবতায় সবাই মিলে দোয়া করলো, আমার জন্য।  
এরপর যে যার মতো তাদের গন্তব্যে চলে গেলো আমারই লাশটাকে ফেলে। 
তারপর? তারপর কি? তারপর কি হলো?