গ্রহণ (৮ পর্ব)

গ্রহণ  (৮ পর্ব)

শামীমা আহমেদ 

অফিস ডেস্কে বসে শাহেদ আজকের টু-ডু-লিস্টটা দেখে নিলো। বেশ কিছু ইম্পর্টেন্ট কাজ গতকাল হাফ ডান করা ছিল। সেগুলো একটা কিনারা করতে হবে। কখন আবার সেগুলোর জন্য কল আসে ! শাহেদ তার পার্সোনাল ল্যাপটপটি ব্যাগ থেকে বের করে নিলো। পার্সোনাল হলেও এটা অফিস থেকেই দেয়া। আসলে কর্পোরেট জবের এটা একধরণের চালাকি। চব্বিশ ঘন্টাই কাজ করিয়ে নেয়ার একটা সুক্ষ ট্রিকস।শাহেদের সার্বক্ষণিকের সঙ্গী এই ল্যাপটপ।চাকুরীটা যেন এই ল্যাপটপটার সাথেই। সেটা খুলে মেইল চেক করে জায়গামত তার রিপ্লাই দেয়া হলো। আর অন্যান্য মেইলে যে সব কাজের ফরমায়েশ আছে তা নোট প্যাডে টুকে নিলো। শুরু হলো দিনের মত কাজে ডুব দেয়া। শাহেদ ভাবলো আগে একটু লাবনীর সাথে কথা বলে নেয়া উচিত। বেচারী ভীষণ একা হয়ে যায় সারাটা দিন। শায়ানকে স্কুল থেকে আনার পর টিভি আর মোবাইলেই সময় কাটানো। সকালে এতটা সময় নিয়ে সবকিছু করে কিন্তু শাহেদ সেভাবে লাবনীকে সময় দিতে পারে না। 

সময়মতো শায়ানকে স্কুল থেকে নিয়ে এসো।

আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।মনে হলো লাবনী প্রচন্ড ব্যস্ত। শুধু আচ্ছা বলেই কথা শেষ করতে চাইল। শাহেদও কথা সংক্ষিপ্ত করে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে কাজে মন দিলো। 

সাড়ে এগারোটার দিকে হালকা স্ন্যাকস এর বিরতি। শাহেদ একটা স্যান্ডউইচ আর এক কাপ কফি নিলো। কফির পেয়েলার ধোয়া ওড়া চোখে পড়তেই শাহেদ কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে উঠল। দীপিকার ধোয়া ওড়া

চা বেশ পছন্দের ছিল। একটু একটু করে সে চায়ে চুমুক দিবে আর গরমে ওর মুখটা লাল হয়ে উঠবে। ক্লাসের শত তাড়া থাকলেও সে এভাবেই চা খাবে। ওদিকে শাহেদের কি আর এত তর সয়! পিরিচে দুবার ঢেলেই তা সুড়ুৎ করে সাবার।বহুদিন এমন ঘটেছে। খুব মনে পড়ে শাহেদের, দীপিকার খবরের পর থেকে ক্যান্টিনের সেই চায়ের স্বাদও বিস্বাদ লাগতো। 

ভাবলো দীপকার সব কথা জানিয়ে শাহেদ ওর মাকে সব খুলে বলবে। দীপিকাকেতো মায়ের ভীষণ পছন্দ। মাকে বলবে কোনভাবে যদি তুমি দীপিকার মায়ের কাছে যেতে পারো তবে হয়তো এই বিয়েটা বন্ধ করার একটা আশা জাগে। 

ইতিমধ্যে জিসানের মাধ্যমে দীপিকার সাথে একটা যোগাযোগ খবর চালাচালি চলছিল।

শাহেদ কোনদিন ভাবেনি যার সাথে প্রতিদিন দেখা হচ্ছে কোনদিন তার সাথে চিঠির মাধ্যমে কথা বলতে হবে। সময় আর পরিস্থিতি অনেক কিছুই বাস্তব করে দেয়।

শাহেদের প্রতি দীপিকার ভাললাগা সেটাতো আগেই প্রকাশিত ছিল। কখন কোন অজান্তে তা দুজনার মনে ভালবাসায় রূপ নিয়েছে আজ দুরত্বের কারণে তা দুজনেই টের পেলো। দীপিকাই জানিয়েছিল শাহেদ যেন তার মাকে নিয়ে ওদের বাসায় যায় এবং দীপিকার মাকে সব খুলে বলে।মা বাবাকে কনভিন্স করতে পারে! আর এব্যাপারে দীপিকার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে। 

শাহেদ অনেকটা আস্বস্ত হয়ে সেদিন একটা ক্লাস বাদ রেখেই বাসায় ফিরে গেলো। অনার্স ফাইনাল চলে এসেছে। এখন যেখানে পড়াশুনোয় মনযোগী হওয়া উচিত সেখানে দীপিকার এই খবরে শাহেদ পড়াশুনায় একেবারেই মন বসাতে পারছিল না। এর আগে যতবারই দীপিকা ওদের বাসায় এসেছে শাহেদের ছোট্ট রুমটাতে বসে ওরা অনেক গুল্প করেছে। মা এটা সেটা বানিয়ে নাস্তা পাঠিয়েছে। ছোট বোন দুটিও দীপিকা ভীষণ ফ্যান হয়ে উঠেছিল।  

সবকিছু শুনে শাহেদের মা বেঁকে বসলেন। তার সম্মতি মিলল না।

শাহেদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

পৃথিবীটা উল্টো ঘুরতে লাগলো। বিধবা মায়ের একমাত্র সম্বল এই ছেলেকে এত দ্রুত সে হারাতে চায় না। তাছাড়া পড়াশুনা শেষ হয়নি। এত বড় ঘরে বিয়ে করালে দুদিন পর এই ছেলে তাদের চিনবেই না। 

আজ দীপিকাকে ছেলের সহপাঠী হিসেবে যেভাবে পাচ্ছে পরবর্তীতে এত ধনী ঘরের মেয়ে তাদের যে তাচ্ছিল্য ভরে দেখবে না তার কী নিশ্চয়তা ? ঘরে দু দুটো মেয়ে, তাদের বিয়ে শাদী ভবিষ্যৎ সবই যে শাহেদের উপর নির্ভর করছে। তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে সেই বা কার কাছে দাঁড়াবে।মায়ের এমন দূর্ভাবনায় শাহেদ রীতিমতো অবাক হয়ে গেলো।

মা শুধু তার দুই মেয়ে আর নিজের কথা ভাবল। শাহেদের ভাললাগা ইচ্ছা চাওয়ার দিকে মায়ের ভ্রুক্ষেপ না করায় শাহেদ একেবারে ভেঙে পড়লো। মায়ের ইচ্ছা শাহেদকে আরো অনেক পড়াশুনা করাবে আর এ ব্যাপারে টাকার যোগান দেবে তার বড় মামা। যার একটা অপরূপা সুন্দরী একটি মেয়ে আছে। তবে শাহেদ কখনোই তেমন কোন দৃষ্টিতে অর দিকে তাকায়নি। তবে মায়ের ভীষণ ইচ্ছা তাকে শাহেদের বউ করে ঘরে আনবে। মামা মামীর তাতে সায় আছে। মেয়েটিও যেন সব বুঝে গেছে। চোখের চাহনী এই বয়সেই অন্যরকম। ইচড়ে পাকা গোছের এই মেয়েটিকে শাহেদের অসহ্য লাগে । বসুন্ধরা সিটিতে শাহেদের মামার শাড়ির দোকান।বেসুমার টাকা। মামা মামীর ভীষণ ইচ্ছা এই টাকার বিনিময়ে তাদের গবেট মেয়েটাকে শাহেদের ঘাড়ে গছানো।

বোন দুটোকেও আজ অচেনা লাগছে ! ওরা বেশ ইনসিকিউরড ফিল করছে । ভাইয়া বিয়ে করলে তাদের ভুলে যাবে। শাহেদ খুব বুঝে নিলো এই দুনিয়ায় অতি আপনজনেরাও স্বার্থের কারনে কেমন অচেনা হয়ে যায়।

শাহেদের আশার সব দরজা যে বন্ধ হয়ে গেলো।মধ্যবিত্ত সমাজে ছেলেরা জন্মায় শুধু দায়িত্ব আর কর্তব্য পালনের জন্য। দিনশেষে নিজের প্রাপ্তিতে থাকে শুন্যতা।

সহকর্মীর সজলের স্পর্শে শাহেদের অতীত ধ্যান ভাঙল। সজল বললো, শাহেদ ভাইয়া বেশ অনেকক্ষণ আপনার মোবাইল ফোন 

বাজছে। আপনি কী এত ভাবছেন ?

শাহেদ লজ্জা, কষ্ট দুঃখ অপ্রাপ্তি ক্ষোভ কিছুটা চাপা অভিমানের একটা অসহায় দৃষ্টিতে সজলের দিকে তাকালো আর সবকিছু মনের ভেতর অব্যক্ত কথার পাথর চাপায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

চলবে.....