ভয় বা ফোবিয়া

ভয় বা ফোবিয়া


সালেহা চৌধুরী

চেম্বার ডিক্সসারীতে ভয বা ফোবিয়াকে বলা  হয়েছে অযৌক্তিক ভয় এবং যার সঙ্গে কিছু ঘৃনাও জমে থাকে। ফোবিয়া নিয়ে একটি বই পড়ছিলাম। বইটি লিখেছেন হেলেন সল নামের একজন ফোবিয়া বিশারদ। বইটির শিরোনাম “ফোবিয়া: ফাইটিং দ্য ফিয়ার”।
 
এ বইটিতে কয়েকটি কেস হিস্ট্রি দেওয়া হয়েছে যা জানতে পারলে আমরা এই রোগের উৎস বের করতে পারি বা কারণ জানতে পারি। যেমন একটি ফোবিয়ার রোগী চিরকাল ভয় পান মেয়েদের কার্ডিগান দেখে। যদি কার্ডিগান পরে কেউ তার সামনে আসে তাহলেই হয়ে গেছে। তিনি সেই রমনী থেকে দূরে থাকতে চান। তার প্রতি বেশ একটু রাগ বা ঘৃনা প্রকাশ করেন। বিয়ে করতে গিয়ে তার প্রেমিকাকে বলেন তুমি যদি তোমার সবগুলো কার্ডিগান আলমারি থেকে ফেলে না দাও তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করবো না এবং মনে রেখ ভবিষ্যতেও তুমি কখনো কার্ডিগান পরতে পারবে না। মেয়েটি রাজি হয়। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটিকে বিয়ে করেন। এখন প্রশ্ন তার এই ফোবিয়ার কারণ কি? কারণ এই তার যখন সারে তিন বছর বয়স তার এক প্রণঘাতী রোগ হয় যার নাম হুপিং কফ। কাশতে কাশতে তার গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে যেতো। সে সময় তার মা গায়ে দিতেন একটি মোহিয়ার কার্ডিগান। আর এই কার্ডিগানের একটু আধটু আঁশ লাগলেই তার কাশি বেড়ে যেতো। তিনি কাশতে কাশতে গলা চিরে রক্ত বের করে ফেলতেন। পরবর্তী জীবনে এই স্মৃতি তাকে সর্বপ্রকার কার্ডিগানের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল। তিনি ওই জিনিসকে দুই চোখে দেখতে পারতেন না। 

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ একধরণের ফোবিয়ায় ভোগেন যার নাম আগ্রোফোবিয়া। বাইরের বিশাল স্পেস তাকে ভীত করে। তিনি বাড়ির নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন। কোনোমতেই কেউ তাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয় এই ফোবিয়ার উৎস সেই গুহামানবের জীবন থেকে শুরু। যখন বাইরের জগত মানে বিপদসংকুল জীবন। সাপ, বাঘ এবং নানা প্রকার ভয়াবহ প্রাণীকে মোকাবেলা করা। বিশাল ঝড় বিষ্টিতে আত্মরক্ষা করা। এর ফলে তারা খুঁজতে শুরু করেন কোনো একটি নিভৃত স্থান যেখানে তারা এসব থেকে দূরে থাকতে পারবেন। এর ফলে তারা বাস করতে শুরু করেন গুহাতে। এরপর বানাতে শেখেন ঘরবাড়ি। যে বাড়ির নিভৃত নিরাপত্তায় তিনি থাকতে ভালোবাসেন। যে কারনে রবিনসন ক্রুশো বাড়ি বানান। এবং আমরা বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করি, মজবুত তালা লাগাই। এই কারনেই বাড়ির বাইরের সেই সুবিশাল স্পেসকে ভয় পান এমন মানুষকে বলা হয় আগরোফোবিক।
 
কেউ কেউ ভয় পান মাকড়সা  যাকে বলা হয় ‘আরাখনোফোবিয়া’।  কেউ কেউ ভয় পান সাপ ‘ওফিডিওফোবিয়া’ , কেউ কেউ ভয় পান অন্ধকার ‘নিকটোফোবিয়া’,  কেউ কেউ ভয় পান কটকটে আলো ‘ফটোফোবিয়া’। সারাহ মেয়ার নামের একজন বয়স্ক মহিলা  কিছুতেই নিজের দাঁত মাজা এবং অন্যের দাঁত মাজা দেখতে চান না। তিনি রীতিমত এ দৃশ্য পরিহার করবার জন্য প্রাণপন করেন। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে ছোটোবেলায় ঘুমোতে যাবার আগে যে ভাবে তাকে দাঁত না মাজার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা থেকেই এই ফোবিয়ার উৎপত্তি। ‘ওডোনটোযারুফোবিয়া’ এর নাম।

কোনো কোনো ফোবিয়ার কারণ পাওয়া যায় না। কেন এমন করে ভয় পায় অত্যন্ত সাধারণ সব জিনিস দেখে। মার্টিন টর্সল্যান্ড বালু দেখে এতো ভয় পান যে কোনোমতেই কেউ তাকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যেতে পারে না। সারা জীবনে একবার তিনি সমুদ সৈকতে গিয়েছিলেন। মাত্র এক ঘন্টা দেখে সৈকত থেকে চলে এসে প্রানে বেঁচেছেন। অবশ্য তার এই ফোবিয়ার কারণ কেউ বলতে পারে না। এর নাম হলো- ‘আমোসফোবিয়া।’

আলফ্রেড হিচকক একটি অসাধারণ সিনেমা বানিয়ে ছিলেন ভার্টিগো নামে। যেখানে উঁচুতে উঠতে পারতেন না সেই সিনেমার নায়ক। আমাদের অনেকেই এই ভার্টিগোতে ভুগতে পারেন। যার অন্য নাম ফিয়ার অব হাইট।  আমি একবার ছোটো বেলায় নওগাঁয় থাকতে বুল বুল চৌধুরীর নাচ দেখতে গিয়ে সিনেমার এক অংশ ভেঙ্গে নিচে পড়ে যাই। এর ফলে আমি দীর্ঘদিন কোনো ব্রিজ বা সাঁকোতে উঠতে পারতাম না। মনে হতো আমি ব্রিজ ভেঙ্গে নিচে পড়ে যাব। বিশেষত নওগাঁয় সে সময় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে রেলের প্লাটফর্মে যেতে হতো ট্রেন ধরতে। আমার ভীতি ও চিৎকারে কাউকে না কাউকে আমার হাত শক্ত করে ধরে না হলে কোলে করে আমাকে সে ব্রিজ পার করে দিতে হতো। হয়তো আমার এই ভীতিকে সে সময় অনেকে মনে করেছেন বাড়ির সর্ব কনিষ্ঠ সন্তানের আল্লাদিপানা। যেমন করে ব্যাখ্যা করা হয় আমাদের সবপ্রকার ভীতিকে। কিন্তু যারা ফোবিয়ার গল্প জানেন তারা ঠিক এমনি ঢালাও কথা বলবেন না। বাতাস দেখে যারা ভয় পান তাদের রোগের নাম  ‘আনেমোফোবিয়া’। একজন নারী এমন এক রোগে ভুগতেন। সাইক্রায়িস্ট তার সবকিছু পরীক্ষা করে জানতে পারলেন যে তিনি একবার যখন ফাক্টরিতে কাজ করতেন ঝড়ে তাদের ফাক্টরির চাল উড়ে যায়। এবং তারা বেশ কিছুক্ষন বেশ একটু অসহায় অবস্থায় সময় কাটিয়ে ছিলেন। এরফলে রাস্তায় বেরোলেই তিনি জোরে বাতাস বইলেই এমন জেলির মতো বস্তু হয়ে যেতেন মনে হতো তার পক্ষে আর চলাফেরা করবার মতো অবস্থা নেই। তাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিছুতেই সারিয়ে তোলা যাচ্ছে না। মহিলা কিছুতেই তার এই ভীতিকে পছন্দ করেন না কিন্তু এ থেকে কি করে বেরিয়ে আসবেন তা তিনি জানেন না। তাকে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিলেন - আপনি আপনার রোগ সারাতে কতটাকা খরচ করতে চান? উত্তরে তিনি বলেছিলেন - যদি আমি কাল লটারি জিতি তাহলে আমার এই টাকার সমস্ত আমি নিজেকে সারিয়ে তুলতে খরচ করতে রাজি আছি। কাজেই যিনি নিজেই ফোবিয়ায় ভোগেন  তার পক্ষে এই অহেতুক ভীতি নিয়ে জীবনযাপন মুশকিল হয়ে যায়, তিনি নিজেই নিেেজকে সারিয়ে তুলতে চান। হাঁটু বা নি দেখে কেউ কেউ ভয় পান তাকে বলা হয় ‘জেনুফোবিয়া’। আবার কেউ বেউ ভয় পান পিনাট বাটার তার তালুতে লেগে আছে তাকে বলা হয় ‘আরাচিবাটুয়ো’ ফোবিয়া। যে সমস্ত লক্ষণকে আমাদের কেউ কেউ বলবেন ঢং দেখে আর বাঁচি না। এখন প্রশ্ন হলো এই সব ফোবিয়া কি কেবল মনের ব্যাপার না এইসব ফোবিয়ার সঙ্গে আমাদের মস্তিস্কের যোগাযোগ আছে। যারা মনে করেন এগুলো কেবল আমাদের মন থেকে তৈরী হয় তারাও দেখতে পাচ্ছেন এগুলো কেবলই মনের ব্যাপার নয় এগুলো আমাদের মস্তিস্কের সঙ্গে সর্র্ম্পকিত। যেমন একজন লোক কিছুতেই সামান্য এক থেকে দশ গুনতে পারেন না যদি তার মাথার উপরে একটি বিশেষ জায়গায় একটি ম্যাগনেট ঝুলিয়ে রাখা হয়। তার সমস্ত গোনা ভুল হতে থাকে। তারপর আবার ম্যাগনেটটি সারিয়ে নিলেই তিনি আবার ঠিকমতো গুনতে পারেন। কাজেই এখানে দেখা যাচ্ছে তার মন নয় তার ব্রেনের কোনো এক জায়গায় এই ফোবিয়ার সমস্যা লুকিয়ে আছে। একজন মহিলা ড্রিলের শব্দকে এতো ভয় পান যে তিনি সেই কারণে ডেনটিস্টের কাছে যেতে চান না । দীর্ঘদিন ধরে তিনি দাঁতের যন্ত্রনায় কষ্ট পেযে দাঁত হারিয়ে ফেলেছেন কিন্তু কেউ তাকে ক্রেন দিয়ে তুলেও ডেনটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে পারেন নি। নিকি গারি নামের একজন বিদূষী নারী কিছুতেই জনতার মুখোমুখি হতে পারতেন না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কথা বললেই তিনি ভয়ে কুঁকড়ে যেতেন। এটা হলো ‘আগরোফোবিয়ার’ একটা অংশ। এই ফোবিয়ার ফলে তাঁর ওজন কমতে শুরু করে এবং তিনি সারে ছয় স্টোন ওজনে চলে আসেন। আর এই রকম হতে শুরু করে যখন তিনি স্কুলে যেতেন এবং তাকে স্কুল এ্যাসেমব্লির সামনে দাঁড়াতে হতো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তারপর একসময় এই অবস্থাতেই তার বিয়ে হয় এবং তিনি প্রেগনান্ট হন। আর এর ফলে তার শরীরে রক্ত চলাচল পক্রিয়ায় পরিবর্তন সাধিত হয়, তাতে করে আস্তে আস্তে তিনি এই ভীতি কাটিয়ে ওঠেন। তারপর যখন তিনি সন্তান প্রসব করেন আস্তে আস্তে তার সব রোগ চলে যায়। অবশ্য ইতোমধ্যে তিনি নানাপ্রকার ওষূধপত্র খেতে শুরু করেন এবং থেরাপি নিতে থাকেন। এখন তিনি সুস্থ হয়ে আবার য়ুনিভার্সিটিতে যেতে শুরু করেছেন। অনেক সময় এই সন্তান সম্ভাবনা একজনকে সম্পূর্ন সারিয়ে তোলে। প্রেগনান্সি হরমোনের ভেতর এমন কিছু থাকে যা অনেকসময় ফোবিয়াকে সারিয়ে তুলতে পারে। 

একজন মানুষ তার বাড়ির দরজা থেকে ভেতরে আসতে সবসময় পেছন ফিরে  হাঁটতেন। তারমধ্যে আবার বাঁ পা আগে ফেলে। তাকে যদি কেউ এ অবস্থায় দেখে বলবে তিনি একেবারে বদ্ধ পাগল। আসলে তিনি মোটেই বদ্ধ পাগল নন। কেবল তিনি দরজা থেকে ঘরে আসতে এমন কান্ড করেন। কাজেই কেউ যদি মাকড়সা বা সাপ দেখে ভয় পায় তাকে মোটেই বদ্ধ পাগল বলা যাবে না কেবল বুঝতে হবে তার এই অবস্থা তার বংশগত জিন, মস্তিস্ক না হলে তার মনের কোনো জায়গা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আর বাদ বাঁকি অংশ একেবারেই সুস্থ। একজনের ফোবিয়া ছিল হাত ধোবার। এর নাম হলো ‘মাইসোফোবিয়া।’ মানে জার্মের ভয়।  হাত ধুতে ধুতে তিনি হাত দুটোকে প্রায় ক্ষয় করে ফেলেছিলেন তবু তার মনে হতো কিছুতেই তার হাতের ময়লা যাচ্ছে না। তিনি এই রোগ নিয়েই মারা যান। কেউ তার এই অসুখ বা ফোবিয়া সারিয়ে তুলতে পারেন নি। রোমান পোলানসকির ‘রিপালসন’  এমনি ফোবিয়ার গল্প। ফোবিয়া যখন মাত্রাতিরিক্ত রূপ পায় তখনই হয়তো সে পাগল নামে আখ্যায়িত হতে পারে। আমার একজন চাচা বাড়িতে চুলো দেখলেই ভেঙ্গে ফেলতেন শেষপর্যন্ত  তিনি অবশ্য ঘোরতর পাগল হয়ে যান। মাটির চুলো যেমন গ্রামে থাকে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ জানা যায় না। তবে কেউ কেউ বলে তাঁর মা এই চুলো নিয়ে পড়ে থাকবার কারণে তাঁকে ছোটবেলায় আদরযত্ন করতে পারে নি। ফলে চুলোর উপর বিতৃষ্ণা ছিল তার। ফোবিয়া ও পাগলামির মধ্যে একটি ফাইন লাইন থাকে কাজেই সব ফোবিয়াগ্রস্ত মানুষ পাগল নন আর সত্যিকারের পাগল অসংখ্য ফোবিয়ার যোগফল। 

ভালোকথা ব্রীজে ওঠার ভয় চলে গেলে এখনও আমার ‘ফিয়ার অফ হাইট’ আছে। ও সারবে না। আর ব্রিজে ওঠার ফোবিয়ার নাম হলো ‘গেফাইরোফোবিয়া’। ভেনিসের ‘ব্রিজ অফ সাই’ এর তলা দিয়ে যখন গিয়েছিলাম এ ভয় ছিল না। আহা কি যে সুন্দর সেই ভেনিস! এখন নাকি পুরো ভেনিস ডুবে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
 
জীবনই এমন। আজ ভালো কাল আর এক রকম। ভেনিসের আর কি দোষ।