মাতৃভাষা কে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস

মাতৃভাষা কে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস

আফিয়া বেগম শিরি

হে মাতৃভাষা বাংলা আমার। বড় কষ্টের অর্জিত সম্পদ তুমি। কিন্তু তোমার কাছে আমি লজ্জিত। কারন, আমিও বিদেশী ভাষা নকল করে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তোমার মুল্যায়ন আমি কতটুকু করছি বা করতে পেরেছি। পুরোপুরি পারছি বলে মনে হয় না।

ছোট বেলা যখন মা খালার মুখের ভাষায় কথা বলতাম প্রতিটি শব্দ ভেতর ছুঁয়ে যেতো। আজ প্রযুক্তির যুগে সেই শব্দগুলো বিলিন হয়ে যাচ্ছে। দখল করে নিচ্ছে বিদেশী শব্দ। হারাতে বসেছি আমার অস্তিত্ব। একটি শিশু জন্ম নেয়ার পরে যখন আধো আধো বোলে কথা বলতে শিখে তখন তাকে মা বাবার মুখের ভাষা শেখানে হয়। তারপর স্কুল কলেজে গেলে নিজের মাতৃভাষার সাথে অন্যান্য ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ইন্টারন্যাশনাল ভাষার উপর দখল থাকতে হয়। বিলেতে যারা সন্তান নিয়ে বসবাস করছি তাদের জন্য কাজ কর্মে সে ভাষার ব্যবহার অত্যাবশ্যক। যে দেশে বসবাস সেই দেশের ভাষা অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু স্কুল কলেজের বাইরে ঘরে যে হারে ইংরেজী ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এতে ভবিষ্যতে মাতৃভাষা কতটুকু ঠিকে থাকবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।

নিজের মাতৃভাষার মতো আত্মতৃপ্তি আর কোনো ভাষাতেই পাওয়া যায় না। যে ভাষার জন্য অকাতরে প্রান দিয়ে শহীদ হলো লক্ষ লক্ষ বীর সন্তান। হারালো অগনিত মা বোনের ইজ্জত সম্ভ্রম সেই ভাষাকে মুল্যায়ন না করে দেশে আমরা বিদেশী ভাষা অহরহ আমদানি করছি। এদিকে বিলেতে আমাদের কোমলমতি বাচ্চাদেরকে নিজের মাতৃভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। ওদের সাথে তাল মিলিয়ে ইংরেজী বোল আওড়াচ্ছি। আমাদের নতুন প্রজন্মরা দিনে দিনে ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। জন্ম এবং বিলেতে বড় হওয়া তৃতীয় চতুর্থ জেনারেশন বাংলা ভাষায় প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। তৃতীয় প্রজন্মের মা বাবা তাদের সন্তানদের সাথে দৈনন্দিন চলা ফেরা কথা বার্তা সবই ইংরেজীতে বলছে।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী এলে বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধাবোধ জানান। তারপর বছরের তিনশ তেতোস্টি দিন আর মাথা ঘামান না। কার সন্তান ইংরেজী ভাষার উপর কয়টা লেটার পেয়েছে তা বলতে শুনি। ভাষা রপ্ত করে কতটুকু স্মার্টনেস তাও অনেকে বলতে ছাড়েন না।

আমি অন্যের কথা আপাতত বাদই দিলাম। কথায় আছে আগে তো ঘর, তবে তো পর। আমার ছয় বছরের নাতি বাবা মার সাথে অহরহ ইংরেজীতে কথা বলে। যাদের সাথে তার সারাদিন উঠবস, তারা তাকে তাদের প্রচলিত ভাষা শেখাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও বাংলার প্রতি তার আকর্ষন আনতে পারছি না। 
একদিন তাকে বললাম নানু দরজাটা বন্ধ করে আসো।(দরজা লাগাও) ও বোবার মত আমার দিকে চেয়েই রইলো। যখন দেখলাম কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না আমি কী বলছি,তখনই ইংরেজীতে বললাম (নানু প্লিজ সাট দ্যা ডোর) এক লাফে সে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমার অন্যান্য নাতীরা ও সবাই ইংরেজীতে কথা বলে। আমি এসব নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। চেষ্টা করেও যাচ্ছি তাদেরকে কিছুটা হলেও আমার ভাষা শেখাতে। তাদের বাবা মা যখন ছোট ছিলো আমরা তাদেরকে বাংলাতে কথা বলা শিখিয়েছি। ভুলেও ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করিনি। বাংলা ভাষার উপর বই পড়িয়েছি, লেখা শিখিয়েছি। যাতে ব্রিটিশ বাংগালি হলেও তার মা বাবার একটা রুট’স আছে। নিজের মাতৃভূমিতে নিয়ে গেলে ওরা বোবার মত চেয়ে থাকবে। বাংলা ভাষায় একটা সাইন পড়তে পারবে না। তাতে আমাদেরই লজ্জা।

বিলেতে সবার ঘরে একই অবস্হা। ছোট ছোট বাচ্চারা পটপট করে ইংরেজীতে কথা বলে। এতো চমৎকার নিখুঁত বলে তা অবাক হওয়ার মতো। আই প্যাড, স্মার্টফোন ,ট্যাবলেটে, মগজ ধোলাই হচ্ছে সবার। এগুলোর ব্যবহার নতুন প্রজন্মের তুলনায় আমরা চিনিই না বললে ভুল হবে না। ছোট পিচ্ছি যতটুকু জানে বড়রা অনেকে হয়তো ততটুকু জানে না। মাতৃভাষাকে আমি যতটুকু অন্তরের গভীর থেকে উপলব্ধি করি নতুন প্রজন্ম তা করবে না ।কারন, তাদের ফার্ষ্ট লাংগুয়েজ ইংলিশ। তাদের পূর্ব পুরুষের ভাষা বাংলা (যেমন আমরা)। তাই তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সবাই যার যার অবস্হান থেকে চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।বাংলা শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় কালচার রীতিনীতি শেখার ব্যবস্হা করতে হবে।

এই লেখাটি অর্ধেক লিখে সময়ের অভাবে শেষ করতে পারিনি। ঠিক তখনই একুশে ফেব্রুয়ারী এসে গেলো। এবারের ভাষা দিবস ওল্ডহ্যামে এক ব্যতিক্রম আয়োজনে পালিত হলো। খুব চমৎকার ভাবে কিছু সমাজসেবী সংগঠন ঊদ্যোগী হয়ে ছোট ছোট বাচ্ছা নিয়ে একুশের দিন সকালে কোনো প্রকার বিশৃংখলা ছাড়া শহীদ মিনারে ফুল অর্পন করলেন। পলিট্রিকস রাজনৈতিক দলাদলির নোংরামির লেশ নেই। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের গার্ডিয়ানদের সাথে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। বড়রা তাদেরকে বুঝিয়ে বলছে ভাষা দিবসের তাৎপর্য্য। সেই সময় শহীদ মিনারের চারপাশের এক খন্ড বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছি। বিদেশীরা তাকিয়ে তাকিযে দেখছে আমাদের গৌরবের ইতিহাস। দেখে খুবই ভালো লাগলো। আয়োজকদের প্রতি অশেষ ধন্যবাদ।

সব সময় এরকম যদি আমরা সম্মিলিত ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর, ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৫ই আগষ্ট, ইতিহাসের শ্রেষ্ট নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বৃত্তান্ত সহ বিভিন্ন দিবস গুলোর তাৎপর্য্য এবং পালনে নতুন প্রজন্মকে সক্রিয় করে তুলি। বাংলা শিক্ষার জন্য বাংলা স্কুলের গুরুত্ব দেই।পারিবারিক ভাবে বাংলা চর্চা অব্যাহত রাখি, তা হলে বিলেতের মাটিতে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ঠিকে থাকার সম্ভাবনা। একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি -মর্যাদা পেয়ে বিশ্বে এক অনন্য নজির স্হাপন করেছে, যা আমাদের জন্য অতি গৌরবের।