রহিমা বেগমের অপহরণের বিষয় ভুয়া প্রমাণিত: পিবিআই

রহিমা বেগমের অপহরণের বিষয় ভুয়া প্রমাণিত: পিবিআই

বাংলাভাষী ডেস্কঃঃ

খুলনার মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম নিখোঁজের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই এবং ওই নারী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে তাকে অপহরণের প্রমাণ পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বরং জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিবেশীদের ফাঁসাতে আত্মগোপনে থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।

জানা গেছে, মরিয়ম মান্নানসহ পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানতেন। অবিলম্বে মরিয়ম ও তার পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন ও নির্দোষ ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি জানান রহিমা বেগম অপহরণ মামলার আসামি মো. মহিউদ্দীনের মেয়ে মালিহা।

মালিহা আরও বলেন, এসবই নাটক। রহিমা বেগমের পরিবার মামলাবাজ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। কয়েক বছর আগেও ৮ থেকে ৯ বছরের এক শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছিলেন রহিমা বেগম। এভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রভাব বিস্তার ও প্রতিবেশীদের দমিয়ে রাখেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রহিমা বান্দরবানে গিয়েছিলেন। সেখানে হোটেলে কাজ নিয়েছিলেন। সেখানকার লোকজনকে বলেছিলেন, তার এক ছেলে ঢাকায় পড়াশোনা করে, টাকার প্রয়োজন। লোকজন তাকে পাশের আরেকটি কাজ ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওই কাজটি ঠিক হয়েও গিয়েছিল, তবে তারা তার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চান। যা সংগ্রহ করার জন্যই তিনি ফরিদপুরে বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামে যান।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই এবং ওই নারী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে তাকে অপহরণের প্রমাণ পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বরং জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিবেশীদের ফাঁসাতে আত্মগোপন করেছিলেন বলে জানায় তদন্তকারী সংস্থাটি।

পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, রহিমার বক্তব্য ও আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেসব বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাকে অপহরণের বিষয়টি আমাদের কাছে ভুয়া প্রমাণ হয়েছে। এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মুশফিক বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত বলা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। সব বিষয়ই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই পরিদর্শক আবদুল মান্নান বলেন, আমরা কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখছি না। মঙ্গলবার বোয়ালমারীর সদর ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, আশ্রয়দাতা আবদুল কুদ্দুসের পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ১০ জনের সাক্ষ্য নিয়েছি।

কুদ্দুসের পরিবারের সদস্যরা পিবিআইকে জানিয়েছেন, রহিমা তাদের কাছে অপহরণের কথা নয়, বরং বলেছিলেন, তার সঙ্গে তার স্বামী বেলাল হাওলাদার ও সন্তানদের সম্পর্ক ভালো না। সে কারণে তিনি সেখানে যান।

মান্নান বলেন, এর সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং বিষয়টি তার স্বামী ও সন্তারাও জানতেন। তবে ঘটনা যাই হোক, এর নেপথ্যে রয়েছে জমিকেন্দ্রিক বিরোধ।

এ বিষয়ে রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সমালোচনা হচ্ছে যে পুরো ঘটনাটা সাজানো, আপনার মা আত্মগোপনে ছিলেন, আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

জবাবে এই নারী বলেন, আমরা কিছুই সাজাইনি। মায়ের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। মায়ের কথা শুনে মনে হয়েছে তিনি অপহৃত হয়েছিলেন। তবে আমি এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। আমার নিজেরও অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।

মরিয়ম আরও বলেন, মাকে চাপ দিয়ে কিছু জানতে চাইনি। তিনি অনেক অসুস্থ। পিবিআই তদন্ত করছে। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। তদন্ত যথাযথ হলে আপনারাও অনেক সত্য জানতে পারবেন।

রহিমা বেগমের প্রতিবেশী রবিউল ইসলাম জানান, রহিমার প্রথম স্বামী আবদুল মান্নান তিন বিয়ে করেছিলেন। এরমধ্যে এক স্ত্রীর ঘরে সন্তান নেই। রহিমার ঘরে তার ৫ মেয়ে ও ১ ছেলে। অন্য স্ত্রীর ঘরে দুই ছেলে; তারা বরগুনার পাথরঘাটায় থাকেন।

বরগুনায় থাকা মান্নানের দুই ছেলে ওয়ারিশসূত্রে মহেশ্বরপাশার জমির একটি অংশ (দুইকাঠা) বিক্রি করেন স্থানীয় এক মুহুরির কাছে।
তিনি ওই জমি দখল নিতে না পেরে প্রতিবেশী গোলাম কিবরিয়া, মহিউদ্দিন ও হেলাল শরীফের কাছে বিক্রি করেন। তারা জমির দখল নিতে গেলে রহিমার সন্তানদের সঙ্গে বিরোধ বাধে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মহেশ্বরপাশার ওই বাড়ির ঘরগুলো ভাড়া দেওয়া। ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া আকলিমা বেগম জানান, রহিমা বেগম এ বাড়িতে থাকেন না। তিনি দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে নগরীর বয়রা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তবে মাঝেমধ্যে একটি ঘরে রহিমা বেগম ও তার দ্বিতীয় স্বামী বেলাল থাকেন।

আকলিমা বলেন, ঘটনার দিন বেলাল স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। রহিমার পানি আনতে গিয়ে না ফেরার কথা বেলালই প্রথম সন্তানদের জানান।

এ মামলায় আটক মহিউদ্দিন ও গোলাম কিবরিয়ার বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, রহিমা বেগমেরও তিন বিয়ে। মেয়ের ঘটকালি করতে আসেন বেলাল, সর্বশেষ রহিমা তাকে বিয়ে করেন। তবে পরের দুই স্বামীর ঘরে তার সন্তান নেই। তার ছোট ভাই গোলাম কিবরিয়া রহিমার সৎ ছেলের কাছ থেকে জমি কেনেন। সেই জমিতে যাতে যেতে না পারে, সে জন্য রহিমা আত্মগোপন করে অপহরণ মামলা দিয়ে তাকে আটক করিয়েছে। রহিমার মেয়ে মরিয়ম পুলিশ ও সাংবাদিকদের মিথ্যা কথা বলে প্রায় এক মাস বিভ্রান্ত করেছে।

এ বিষয়ে মরিয়ম মান্নান বলেন, আমার সৎ ভাইরা তাদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রতিবেশীর কাছে। শরিক হিসেবে বিষয়টি সুরাহার জন্য মা মামলা করেন। ওই মামলার জেরে ওই প্রতিবেশীরা মায়ের ওপর হামলা করে। সেটি নিয়ে মামলা চলছিল।

মরিয়ম বলেন, ওদের কারণে প্রায় এক বছর ধরে নিজের বাড়ি ছেড়ে মা ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে আসতেন। ঘটনার আগের দিন তিনি এসেছিলেন। পরদিন নিখেঁজ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা ওই প্রতিবেশীদের সন্দেহ করেছি।

গত ২৭ আগস্ট খুলনার মহেশ্বরপাশা এলাকার বাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন রহিমা বেগম। সম্ভাব্য সবস্থানে খুঁজেও তার সন্ধান না পেয়ে বাড়ির লোকজন থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে রহিমার মেয়ে আদুরি আক্তার অপহরণের মামলা করেন। আদালত ১৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি পিবিআইতে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর নথিপত্র বুঝে নেয় পুলিশের ওই ইউনিট। এ ঘটনায় রহিমার স্বামী হেলাল হাওলাদারসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এর মধ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা গ্রামের ঝোঁপ থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারীর মরদেহকে নিজের মায়ের বলে দাবি করেন মরিয়ম মান্নান। পরদিন ফুলপুরে গিয়ে মরদেহটি মায়ের বলে শনাক্ত করেন। তবে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রাম থেকে রহিমাকে উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি এখন মরিয়ম মান্নানের সঙ্গে ঢাকার বসুন্ধরার বাসায় আছেন।

৫৫ বছর বয়সী এ নারীর সন্ধান চেয়ে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক মাস ধরে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তার সন্তানরা।