হজ্জ (গল্প)

হজ্জ (গল্প)
মেরী খাতুন 


বারান্দায় বসে ধ্যান করে উঠে খবরের কাগজটা মুখের উপর ধরলেন মনসুর আলি। সকালে এক ঘন্টা এসে ধ্যানে বসেন রোজ।

মনসুর আলি রোদ্দুর হতে পেরেছিলেন।  শিশুদের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালানোই ওঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মনসুর আলির হাত ধরে বছর বছর শত শত বিদ্যার্থী পাশ করে এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে একসময়। দু-বছর হল উনি অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসর গ্রহণের পর মনসুর আলি বাড়িতেই অবৈতনিক স্কুল খুলেছিলেন। কিন্তু সেভাবে ছাত্র না আসায় বন্ধ করতে হয়েছিল।

খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে, খবর তো নয়,  বিজ্ঞাপনে ভর্তি। পুরোটা একটু পরেই পড়বো বলে,

------সালেহা, আমায় আর এককাপ চা দেবে?
-----এই তো সবে চা খেলে? আমি আর পারি না বাপু। এখন তো টিফিনটা করবো, মমতাজকে স্কুলে নিয়ে যাব।আমারও তো বয়স হচ্ছে। তোমার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় বয়স তোমার একারই বাড়ছে।ব্যাস দু-এক কথায় ঝামেলা শুরু। দিনরাত দুটির সাথে ঝামেলা। আবার একজনকে ছাড়া অন্যজন অচল।

মনসুর আলি ও সালেহা বিবির পঁয়ত্রিশ বছরের সংসার।  পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে মনসুর। সুন্দরী এবং গুণী সালেহা অতি অল্প দিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জয় করে নেয়। সকলের যেন চোখের মণি হয়ে উঠে সালেহা।

তিন বছরের মাথায় তাদের একমাত্র সন্তান লুৎফা আসে।কনভেপ্টে পড়া মেয়ে লুৎফা নিজ বুদ্ধিমত্তায় মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন হয়ে পরবর্তীতে আমেরিকা পারি দেয়। বিদেশীকে বিয়ে করে আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়ে, বৃদ্ধ- মা-বাবার আর খোঁজ খবর টুকুও রাখে না। আজ আর কোন যোগাযোগও নেই। পরিবারের মানুষজন কমতে কমতে একদম তলানীতে এসে পৌঁছেছে। এখন সংসারে কর্তা, গিন্নী আর ছোট ভাগ্নি মমতাজ ছাড়া আর কেউ নেই।  


মমতাজ মনসুর আলির বোনের মেয়ে। মালদার কাছে এক গ্রামে ওর বিয়ে হয়েছিল। মমতাজের একটা ছোট ভাই ছিল। ওদের বিশাল আমবাগান ছিল। শরিকি ঝামেলায় ওদের জমি আর বাগান হাতছাড়া হয়ে গেছিল। এক জল ঝড়ের রাতে ওর বাবা মাকে মেরে ফেলেছিল ওর নিজের কাকারাই। আলমারির পিছনে লুকিয়ে সাত বছরের মেয়েটা দেখেছিল সেই ঘটনা যা আজও ওর স্বপ্নে ঘুরে ঘুরে আসে। ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গেছিল কাকারা। ও কিছুই করতে পারে নি। এরপর ওর জায়গা হয় আমার কাছে। ভাইকে আর দেখতে পায় নি কখনো।

রাগে গজগজ করতে করতে এই নাও, তোমার চা বলে,
অকালে বাবা-মা মরা মমতাজকে হাতে ধরে হাঁটতে হাঁটতে সালেহা বিবি গ্রামের শেষ প্রান্তে গজিয়ে ওঠা বিশাল প্রসাদসম ইংরেজি মিডিয়ার স্কুলে পৌঁচ্ছে দিতে চলে যায়। যদিও বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। মমতাজ একা একা যেতে পারবে। কিন্তু কেউ ঠিক করে জানে না, যে কী গূঢ় রহস্যময় কারণে সবারই বাড়ির অভিভাবকেরা তাদের ছলে মেয়েদের স্কুলে পৌঁচ্ছে দেয়। তাই মমতাজকেও তারা পৌঁচ্ছে দেয়। মনসুর আলি হিসেব করে দেখে, সালেহার স্কুল থেকে ফিরে আসতে মিনিট কুড়ি লাগবেই।  বাড়িতে কেউ নেই। বিছানার তলা থেকে এস বি আই ব্যাঙ্কের পাস বইটা আস্তে আস্তে টেনে বের করে মনসুর। তারপর একটু ইতস্তত করে, জানলার দিকে উঁকি মেরে, কেউ ধারে পাশে নেই, এটা নিশ্চিত হয়ে, দড়ি বাধা মোটা কাঁচের চশমটা চোখে দিয়েই,  ব্যাঙ্কের পাস বইটা হাতে নিয়ে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে। মনের আনন্দে অস্ফুটে স্বরে বলে উঠে  আর মাত্র দশ হাজার টাকা! তারপর তার দীর্ঘ বছরের সুপ্ত ইচ্ছা পূরণ হবে। সে হজ্জ যাত্রা করতে পারবে। তার আর কোন চিন্তা নেই। বলেই আবার যথাস্থানে ব্যাঙ্কের পাসবইটা রেখে দরজার দিকে তাকাতেই দেখে, সালেহা চৌকাঠ ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
------সালেহা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে, কৌতূহল দৃষ্টিতে বলে, হ্যাঁ গো, তুমি কী সত্যিই হজ্জ করতে যাবে।
------হুম।  যাবো। বিহ্বলভাব কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলে মনসুর।
কিছু কিছু তীর্থস্থান এই ধরাধামে আছে। ধার্মিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, সেখানে একবার পৌঁচ্ছাতে পারলে তার স্বর্গের প্রবেশদ্বার কেউ রুদ্ধ করতে পারবে না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মনসুর আলিও অন্য আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই সেই বিশ্বাসকে দীর্ঘ বছর ধরে অন্তরের অন্তিম স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। তাই সুদীর্ঘ চাকুরিকাল ব্যাপী সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব পালন করেও তিল তিল পরিমাণ টাকা বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই টাকা আজ ব্যাঙ্কে জমা হতে হতে পাঁচ লাখ নব্বই হাজার হয়েছে।

সালেহা বিবি স্বামীর পাশে এসে বসে বলে, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার?
------স্ত্রীর প্রশ্নটির উত্তর এড়িয়ে মনসুর আদরের স্বরে বলে,  জানো গিন্নী, যতদিন চাকরী করেছি, ততদিন শুধু  তোমার ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ, মেয়ের লেখাপড়া, ওর ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া সেই স্বপ্নই দেখেছি। আর সে কাজ আমি সাফল্যের সাথে সমাধান করেছি। শুষ্ক মুখে একটু হেসে বলে, সে নিয়ে আজ আর আমার কোন দুঃখ বা কষ্ট নেই।
-----তবে কি? স্বামীর চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা নীচু করে বলে সালেহা বিবি।
মনসুর তার স্ত্রীর হাতটা টেনে, নিজের উরুর উপরে রেখে সালেহা বিবির মুখটা তুলে বলে, আমার এতদিন সব ইচ্ছেই আল্লাহ পূর্ণ করেছেন। শেষ ইচ্ছা একবার মক্কায় হজ্জ করতে যাওয়া। এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্নও বলতে পারো।
সালেহা বিবি স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। তারপর দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া মাগে। হে আল্লাহ!তুমি আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করো।
পরদিন মনসুর পাসপোর্টের জন্য ফর্ম পূরণ করছে। ফর্মটা পুরোটা ফিলাপ করে নীচে স্বাক্ষর করতে, মনসুর ডাক দেয়----মমতাজ।

মমতাজ ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে বসে ড্রইং এর খাতার উপর রঙ পেন্সিল দিয়ে একটা মক্কার ছবি আঁকছে। মামার গলার স্বর কানে যেতেই,  কী মামা? আমায় ডাকছো?
----হ্যাঁ তোর মামিকে একবার ডাক দেখি। দরকার আছে। মমতাজ রান্নাঘরে মামিকে ডাকতে চলে যায়।
মনসুর এই ছোট ভাগ্নিটিকে ভীষণ আদর, স্নেহে মানুষ করছে। নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। মমতাজের বয়স কম হলে কী হবে! সে কাজে যেমন,লেখাপড়াতেও তেমনি সমান পারদর্শী।

মমতাজ তার মামিকে সাথে করে মামার কাছে নিয়ে আসে, এবং যথারীতি মক্কার ছবিতে লাস্ট ফিনিশিং করতে লেগে পড়ে।
এদিকে মনসুর তার স্ত্রীকে বলে  আগামীকাল ফর্মটা পাসপোর্ট অফিসে জমা দিতে যাব। আশা করি কয়েকদিন পরেই কাজ হয়ে যাবে।

মমতাজ কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, ওটা কিসের ফর্ম মামা?
------ও তুই বুঝবি না মা।
-----কেন বুঝব না? বুঝিয়ে দিলেই বুঝব,  মমতাজ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।
-----যারা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কোন কাজের জন্য যায় তাদের পাসপোর্ট ভিসা লাগে। পাসপোর্ট ছাড়া কিছুতেই কেউ অন্য দেশে যেতে পারে না।
-----কিন্তু, মামা। তুমি অন্য দেশে কেন যাবে? আমরা যাব না?
------ধুর পাগলি! আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে কিছুদিনের মধ্যে আরব দেশে মক্কায় হজ্জ করতে যাব।
-----মমতাজ দৌড়ে গিয়ে তার আঁকা মক্কার ছবিটা মামাকে দেখিয়ে বলে, মামা তুমি এখানে যাবে?

সালেহা বিবি হঠাৎ স্বামীকে থামিয়ে বলে, একে বুঝিয়ে কাজ নেই। তুমি বরং মাথা ঠান্ডা করে কী কী করতে হবে সেগুলো করো। আমার এখন অনেক রান্না বাকি।আয়,মমতাজ বলে, ওকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মনসুর আলি,স্নান, খাওয়া-দাওয়া করে ন'টার মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার জন্য। এদিকে মমতাজও স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। মনসুর ওকে ডেকে বলল,  চল মমতাজ আজ তোকে আমি স্কুলে পৌচ্ছে দিই।
মামার কথা শুনে চুলের দুদিকে লাল ফিতে দিয়ে বেণী দুলিয়ে খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ে।

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এক হাতে মমতাজের কচি নরম হাত ধরে হাঁটতে শুরু করেন। মনসুর প্রথমে ভাগ্নিকে স্কুলে ছেড়ে, পাসপোর্ট অফিসে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমত কিছুটা হাঁটার পর মমতাজ দেখে, রাস্তার ধারে জীর্ণ মলিন বস্ত্র পরা, এক ভিক্ষুক বসে আছেন।
-----মামা একটু দাঁড়াও তো,
------কেন মা?
চোখের পলকে মমতাজ ব্যাগ থেকে দুটাকা বের করে ভিক্ষুকটিকে দেয়, মনে মনে এক অসীম সুখ অনুভব করে। ভিক্ষারীর মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে যেই মামার হাত ধরতে যাবে, অমনি একটি বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মমতাজকে সজোরে ধাক্কা মারে। সে পিচ রাস্তার উপরে লুটিয়ে পড়ে। তার স্কুল ব্যাগটি দূরে ছিটকে গিয়ে এই দৃশ্যের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরনের স্কুল ড্রেস রক্তে লাল হয়ে কালো পিচের উপরে গড়িয়ে যাচ্ছে। মনসুর ভয় পেয়ে যায়। বাঁচাও, বাঁচাও করে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে। ক্ষণিকের ঘোর কাটিয়ে লোকজনের সাহায্যে নিকটবর্তী নার্সিংহোমে ভর্তি করে।

চোখের জল মুছতে মুছতে ডাক্তারের কাছে, করজোড়ে অনুরোধ করে  ডাক্তার বাবু আমার মেয়েকে বাঁচান--,-বাঁচান। ওটি রুমের পাশেই মনসুর নিথর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একমনে শুধু আল্লাহকে ডাকে।
কিছুক্ষণ পরে ওটি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে মনসুরকে ডেকে জানায়, পেশেন্টের মাথায় খুব জোরে আঘাত লেগেছে। অস্ত্রোপচার করতে হবে। ক্ষণিকের জন্য চোখের সামনে তীব্র আলোকে স্তব্ধ হয়ে যায় মনসুর। চারিদিকে ঝাপসা দেখে। অনেক টাকার দরকার। সে কোথায় এত টাকা পাবে। ওর কাছে যে টাকা আছে সে টাকা তো হজ্জের জন্য। না, না। ওই টাকা ও কেমন করে  দেবে। সে তো দীর্ঘ বছর ধরে একটু একটু করে সঞ্চিত করার টাকা। তাহলে তার শেষ ইচ্ছাই পূরণ হবে না। না,এ হতে পারে না। ও আর ভাবতে পারছে না। মাথা ঘুরতে থাকে।
একদিকে তার শেষ ইচ্ছে হজ্জে যাওয়ার, অন্যদিকে মেয়ের জীবন বাঁচানো। সে কিছুই ভেবে পায় না। মমতাজের মুখটা বারবার মনসুরের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কানে চিৎকার শুনতে পাচ্ছে,  মামা আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও। 
না, না।---- এ আমি  কী করছি?  মনসুরের মাথাটা যেন ঝিমঝিম করে ওঠে। মমতাজের আর্তচিৎকার স্পষ্ট শুনতে পায়। না, আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করবে না। ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে বলে, ডাক্তারবাবু যত টাকার প্রয়োজন, দেব। শুধু মেয়েটাকে বাঁচান। এদিকে খবর পেয়েই ছুটে আসে মমতাজের মামি সালেহা বিবি। 'কী করে এমন হলো বলো তো! গোটা বাড়িই তো মাতিয়ে রাখত।' ওর কিছু হয়ে গেলে আমরা কাকে নিয়ে বাঁচবো। আল্লাহ তুমি এতো নিষ্ঠুর হতে পারো না। ওকে বাঁচাও, এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

দীর্ঘ কুড়ি দিন যমে-মানুষের টানাটানির পর মমতাজ আজ সম্পূর্ণ সুস্থ। মমতাজ মামাকে দেখে খিলখিল হেসে ওঠে। মনসুর যত বার ওর মুখের দিকে তাকায় ততবারই ওর মুখে মক্কার ছবি ভাসে। মনে মনে বলে একটি প্রাণের সেবায় অর্থ বিনিয়োগ করা নফল হজ্জের চেয়েও অনেক বেশি গুরুপূর্ণ ইবাদত। হজ্জ শব্দের অর্থ  ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা। আমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে, আমি মমতাজের মুখে হাসি ফুটিয়েছি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।

মামা ডাকে স্তম্ভিত ফিরে, মমতাজকে জড়িয়ে ধরে বলে, কতদিন তোর মামা ডাক শুনিনি বল তো? আয়, আমার বুকে আয়। দুজনের চোখ ঝাপসা গাল বেয়ে অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে। মামার বুকে মাথা রাখে মমতাজ। পকেট থেকে রুমাল বের করে মমতাজের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে,
------সেই পাগলীই থেকে গেলি।
নার্সিংহোম থেকে মামা-ভাগ্নে হাসতে হাসতে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।