আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাসের গল্প: সংখ্যালঘু নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের কূট অপপ্রচার”

জুলাই বিপ্লবের পর থেকে ভারতের সরকার এবং গনমাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে।
তারা “আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাস”, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদসহ নানা অপপ্রচার চালিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করছে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দলীয় নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ভারত এখন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রকাশ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যে ‘সন্ত্রাসের তত্ত্ব’ তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচার করছে, বাস্তবে সেই সন্ত্রাসই ঘটছে ভারতের ভেতরে—সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাধ্যমে।
আমরা আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাস” (Ideological Terrorism বা Ideological Extremism) বলতে কি বোঝানো হয় বোঝার চেষ্টা করব —
কোনো চিন্তাধারা, মতবাদ বা মতাদর্শকে জোর করে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া, এবং সেই মতাদর্শের বিরোধী মানুষদের ভয় দেখানো, নিপীড়ন করা বা দমন করা।
সহজভাবে বললে —
যখন কেউ বা কোনো গোষ্ঠী ভাবে, “আমাদের চিন্তাধারাই একমাত্র সত্য,” এবং তারা সেই ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য হিংসা, ভয়, বা প্রচারযুদ্ধ ব্যবহার করে, সেটাকেই বলা হয় আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাস।
এই সন্ত্রাসের মূল অস্ত্র হলো তথ্য, প্রচার ও প্রভাব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের পরিসরে এক ধরনের চিন্তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে অন্য মতকে “বিরুদ্ধ”, “অশুভ” বা “রাষ্ট্রবিরোধী” আখ্যা দেওয়া হয়। ফলে সমাজে উদারতা ও মতের বহুত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।
আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এটি অদৃশ্যভাবে মানুষের চিন্তা, মনন ও বিবেককে বন্দি করে ফেলে। এতে যুক্তিবোধের পরিবর্তে অন্ধ আনুগত্য জন্ম নেয়। রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা, এমনকি ধর্মীয় ব্যাখ্যাতেও বিভাজন সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে সমাজে সংলাপ ও সহনশীলতার জায়গায় আসে ঘৃণা, বিভাজন ও সহিংসতা।
ভারতের এই অপপ্রচারের বাস্তব চিত্র সম্পন্ন ভিন্ন। নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন এবং তার দল বিজেপি গোটা ভারতবর্ষকে রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণাগুলো—ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র—ধীরে ধীরে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। ভিন্নমত প্রকাশকারীদের দেশদ্রোহী বা ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ তকমা দিয়ে দমন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত, মতাদর্শিক একচেটিয়াকরণ যেন এক অঘোষিত সেন্সরশিপে রূপ নিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভ এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে যাতে হিন্দুত্বই হয় একমাত্র দেশপ্রেমের মাপকাঠি।
ভারতে মুসলিম নির্যাতন একটি বহুমাত্রিক ও চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা মূলত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রীয় নীতির প্রভাবে গঠিত। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়—
১. সামাজিক সহিংসতা:
মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণপিটুনি, মব লিঞ্চিং, গোরক্ষার নামে হত্যা, এবং ধর্মীয় উস্কানিমূলক প্রচারণা বেড়েছে বিশেষত ২০১৪ সালের পর থেকে।
গরু রক্ষক” গোষ্ঠীর হামলা — মুসলিম ব্যক্তি বা গরু-সম্পর্কিত অভিযোগে। দাবি করা হয় যে এসব হামলা বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন হস্তক্ষেপ করছেন না।
২. রাজনৈতিক বৈষম্য:
মুসলিমরা সংসদ, প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণী পদে ক্রমশ কম প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছেন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারে মুসলিম মন্ত্রী প্রায় অনুপস্থিত।
৩. নাগরিকত্ব ও আইনগত নিপীড়ন:
অসমে NRC ও সারা দেশে CAA (Citizenship Amendment Act) মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রশ্নে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। অনেকে এটিকে ধর্মভিত্তিক বৈষম্য হিসেবে দেখছেন।
৪. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দমন:
আজান, হিজাব, কুরবানির মতো ধর্মীয় চর্চাগুলোকে কেন্দ্র করে মুসলিম পরিচয়কে সংকুচিত করার প্রবণতা দেখা যায়।
৫. গণমাধ্যম ও প্রচারণা:
বিভিন্ন মূলধারার টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা প্রায় নিয়মিত।
৬. অর্থনৈতিক বৈষম্য:
মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশ শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসায়িক সুযোগ থেকে বঞ্চিত, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছে।
সমগ্র ভারতের অন্তরে অভ্যন্তরে বহু রাজ্য হিন্দু মৌলবাদ সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রতিরোধের ডাক এসেছে।
সাংবিধানিক ও মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগ
মহারাষ্ট্রে জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫-এ প্রায় ৮০০টিরও বেশি ধর্মীয় উত্তেজনার ঘটনা হয়েছে।
তথ্য Hindustan Times
যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিপোর্টে/different আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০১৪ সালের পর থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর অভিযোগ, সামাজিক বয়কট, ধর্মান্তর বাধ্য করার প্রচেষ্টা, ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন প্রয়োগ বেড়েছে।
মার্চ ২০২৫-এ মহারাষ্ট্রের নাগপুরে অরঙ্গজেবের সমাধি তুলে দেওয়ার দাবি নিয়ে হিন্দু সংগঠনগুলোর আন্দোলন ও মুসলিম-হিন্দু উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
CSSS রিপোর্ট অনুসারে ২০২৪ সালে ভারতজুড়ে “কমিউনাল (ধর্মীয়) হিংসা” ২০২৩-র তুলনায় প্রায় ৮৪% পেরিয়েছে।
“Hindutva Watch” ও “Bridge Initiative” এর মতো সংস্থাগুলো বলেছে যে, হিংসা ও বিদ্বেষমূলক কার্যকলাপগুলোর বেশিরভাগই এমন রাজ্যগুলোর মধ্যে যেখানে বিজেপি জোরালো রাজনীতিতে আছে।
এই ‘আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাস’-এর গভীরতা বোঝা যায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, বা গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনাগুলোতে। এখানে সন্ত্রাস মানে অস্ত্র নয়—ভয়, ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি।
ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে “সংখ্যালঘু নিরাপত্তা” ইস্যুতে ধারাবাহিক অপপ্রচার আসলে একধরনের আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাসের অংশ—যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও আঞ্চলিক মানসিক বিভাজন সৃষ্টি করা। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ ভারতের কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও গণমাধ্যম এই বাস্তবতাকে বিকৃত করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতি নষ্ট করার কূট কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ধরনের অপপ্রচার শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নই করে না, দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিও দুর্বল করে। তাই আজ প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক জবাব, সচেতন কূটনৈতিক তৎপরতা এবং সমাজে ঐক্য ও সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আইডিয়োলজিক্যাল সন্ত্রাসের প্রতিকার হবে সত্যের জোর, যুক্তির আলো এবং জাতীয় ঐক্যের অটুট প্রাচীর গড়ে তোলার মাধ্যমে।
মিসবাহ উদ্দিন আহমদ
নিউইয়র্ক ইউএসএ