গ্রহণ ( শেষ পর্ব) 

গ্রহণ  ( শেষ পর্ব) 

শামীমা আহমেদ 

সজলের ডাকে সাড়া দিয়ে শাহেদ মোবাইল স্ক্রীণের দিকে তাকালো। দীপিকা ফোনের ওপ্রান্তে। দীপিকার নামটি শাহেদের ফোনে দীপক নামে সেইভ করা। হয়তো এটা লাবনীর চোখ এড়াতে! যদিও লাবনী এসব ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। অন্যসব স্রীরা যেখানে স্বামীর গতিবিধি ট্র‍্যাক রাখতে ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে,অফিসে স্পাই লাগিয়ে রাখে, দিনশেষে ফোনের মেসেজ চেক করে,কোন ফোন এলে আড়িপেতে তা শুনে, রাতে মিথ্যে ঘুমের অভিনয়ে স্বামীকে পাহারা দেয়, সারাক্ষণ সন্দিহান মন নিয়ে চলে প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্ন, সেখানে লাবনী এইসব ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার। পক্ষান্তরে লাবনীর স্বামীর প্রতি কেমন এক অগাধ বিশ্বাস।অবশ্য এ পর্যন্ত শাহেদ লাবনীর বিশ্বাস ভঙ্গের কিছুই করেনি।

তবে দীপিকার ফোন আসার পর থেকে একটু একটু করে কেমন যেন লাবনীকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।যদিও এই পরিবর্তনটিও লাবনীর চোখে ধরা পড়ছে না। 

শাহেদ দীপক,, না না দীপিকার ফোনটি রিসিভ করলো।

হ্যালো,,

---- বলে রুম থেকে উঠে একটু সামনের খোলা ব্যালকনিতে কফি লাউঞ্জের পাশে দাঁড়ালো। কাজের অত্যাধিক চাপ পড়লে একটু খোলা জায়গায় হাওয়া- বাতাসের জন্য শাহেদ এখানে এসে দাঁড়ায়।

দীপিকা জানতে চাইলো, শাহেদ, কেমন আছো?

শাহেদ বেশ স্পষ্ট ভাবে বলতে পারলো না যে আমি ভাল আছি।

কেমন যেন হালকা করে বলা, এইতো দিন কাটছে।

-----এভাবে বলছো কেনো? সবকিছু মিলিয়ে তুমি তো এখন সম্পূর্ণ একজন সুখী মানুষ। 

-------হয়তো দেখতে তাই। তবে এই সুখ জোড়াতালি দিয়ে লাগিয়ে নেয়া।নিজে থেকে সুখ নামক বৃক্ষের জন্ম হয়নি।

------- এভাবে বলছো কেন? এ দুঃখতো

আমার। আমার এই শুন্য জীবন টেনে নেয়া।

-----দীপিকা, এভাবে বলে আমায় আর অপরাধী করোনা। তোমায় কষ্ট দিয়ে আমি শান্তিতে নেই।

-----ছিঃ শাহেদ এভাবে বলোনা। সবই আমার অদৃষ্ট । নয়তো চারপাশে আমার সব

থেকেও আজ আমি একাকিনী। 

------আর এজন্য আমিই দায়ী। 

শাহেদের জীবনের শান্ত নদীতে যেন এক তুফান বয়ে যাচ্ছে। সামাজিক কাঠামো আর অর্থনৈতিক বৈষম্য আজো যেন ভালবাসার অন্তরায় হয়ে উঁচু দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে। আর এজন্য কতইনা কুসুমের মত কোমল প্রাণের ভালবাসার কলি অকালেই ঝরে যাচ্ছে। আর পিতামাতারাও মাঝে মাঝে ভীষণ অবুঝ হয়ে উঠে। তাদের জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানকে দেখে। বুঝেনা বা বুঝতে চায়না সন্তানদের ইচ্ছা চাওয়ায় ভিন্নতা থাকতে পারে।

দীপিকা নিরুত্তর রইল। এরপর নীরবতা ভএঙে সরব হলো।

----- শাহেদ, আমি সেদিনের সবকিছুর জন্য খুবই লজ্জিত। এভাবে তোমাকে কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি। এরপর থেকে আমি ভীষণ অস্থিরতায় ভুগেছি।

------তুমি ভুল কিছু বলো নি, ভুল কিছু করো নি। পথের যে বাঁক থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি যদি তা সরলরেখায় চলতো 

তবে তোমার সেই কথা, সেই চাওয়া মোটেও অবান্তর হতো না।

-------তবুও এভাবে তোমার সংসার ছেড়ে আমায় গ্রহণ করার কথা বলে তোমাকে অপ্রস্তুত করা মোটেও উচিত হয়নি। আমি সেদিন নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি, তোমাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছেটা সেদিন আমাকে ভীষণভাবে আবেগী করে তুলেছিল। তাইতো তোমার খুব কাছে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে তুমি ভুল বুঝনা। যে চাঁদে অমাবস্যার গ্রহণ লেগেছে সে চাঁদকে আলোকময় জোসনা আর গ্রহণ করে না। তোমায় ভেবে আমার কবিতার খাতা আজ পূর্ণ।কবিতায় আমি তোমাকে খুঁজেছি,কবিতায় পেয়েছি।, কবিতাতেই খুঁজে যাবো আজীবন।

-----ও প্রান্তে শাহেদ নীরবতায় সব কথা শুনছে। কিন্তু সে বলে বুঝাতে পারছে না ভূমিতে আছড়ে পড়ে যে ঝর্ণাধারা হঠাৎ

থমকে যায় আজীবন পিয়াসী সে ভূমির ক্রন্দন ঝর্ণাধারার ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

----ও প্রান্তে দীপিকা কাঁদছে।

-----এ প্রান্তে শাহেদ নীরব। 

এরপর দীপিকা আর কোনদিন শাহেদকে ফোন করেনি আর শাহেদের কোন ফোনও রিসিভ করেনি।অদেখা লাবনীর জন্য তার একবুক ভালবাসা জমেছে। লাবনীর সরলতায় সে শাহেদকে বেঁধেছে। শাহেদও লাবনীকে পেয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছিল। তাইতো পরম নির্ভরতায় লাবনীর কাছে

সে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। স্রী সন্তান নিয়ে ছিমছাম গোছানো সংসারটিতে দীপিকা প্রলয় ঝড় হয়ে বয়ে যেতে চায় না। চিরকালই দীপিকা নীরব প্রতিবাদে নিজের অবস্থানটা জানিয়েছে।আজও তাই আর বলার কিছু নেই।শাহেদের জীবনে দীপিকার ভালবাসা অস্তমিত সূর্যের মত বিলীন হয়ে যাক।লাবনীর সাহচার্য আর ভালবাসায় শাহেদের বাকী জীবনের চলাটুকু সুন্দর হউক।এটাই দীপিকার একান্ত চাওয়া। দীপিকা তাই শাহেদের জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল।