সিলেটের চা বাগানের নারীরা এখনো জানেন না স্যানিটারি ন্যাপকিন কী

সুবর্ণা হামিদ : সিলেট থেকে
সকালবেলা যখন চা-বাগানের মেঠো পথে ভেসে আসে নারীদের পা ফেলার ছন্দ, তখনই চোখে পড়ে এক নিঃশব্দ সংগ্রাম। মাথায় ঝুড়ি, চোখে ক্লান্তি, আর শরীরে এক গোপন যন্ত্রণার ভার। এই নারীরা শুধু চা-পাতা তোলেন না; তাঁরা পরিবারের হাল ধরেন, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। তবু তাঁদের জীবনের এক প্রাকৃতিক বিষয় ‘মাসিক’ এখনও রয়ে গেছে চুপিসারে, লজ্জার আড়ালে।
সিলেটের সবুজ চা-বাগানগুলো যেন বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা এক গ্রহ। এখানকার শত শত নারী-কিশোরী জানেই না ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন’ কী, কেমন করে ব্যবহার করতে হয়, কিংবা কেন এটি তাদের জন্য জরুরি। আর যারা জানে, তাদের পক্ষে তা কেনা এক বিলাসিতা। এই অজ্ঞতা ও অভাব থেকেই জন্ম নিচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, সংক্রমণ, এমনকি বন্ধ্যাত্বের মতো ভয়াবহ পরিণতির। ‘লজ্জা’র নামে তারা হারিয়ে ফেলছে নিজের শরীর, নিজের অধিকার। আর এই নীরবতা, এই ভুল চুপ থাকা, তাদের ঠেলে দিচ্ছে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।
সিলেটের দলদলি চা-বাগানের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুপ্রীতি নায়েক মিতা লজ্জা ভরা কণ্ঠে বলেন, “মা-খালাদের পুরনো কাপড়ের টুকরাই আমাদের ভরসা। দোকানে কী বিক্রি হয় জানি না, আর জানলেও কেনার সামর্থ্য নেই।”
শুধু মিতাই নয়-তার মতোই পূর্ণিমা দাস, বুলেন্টি দাসসহ অনেক কিশোরী জানে না স্যানিটারি ন্যাপকিন কী, কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, বা কেন তা জরুরি। স্যানিটারি প্যাড তাদের কাছে যেন "শহরের বিলাসিতা", যার কথা বলা মানেই 'লজ্জার দেয়ালে' মাথা ঠোকা।
দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যখন শত শত নারী চা-বাগানে কাজে বেরিয়ে পড়েন, তখন তাঁদের শরীরে হয়তো বইছে রক্তক্ষরণ, ব্যথা, জ্বালা। কিন্তু কেউ জানে না। কারণ ‘মাসিক’ লুকিয়ে রাখতে হয়। পুরোনো শাড়ির টুকরো, বিছানার ছেঁড়া চাদর, এমনকি পাটের টুকরোই হয় আশ্রয়। এসব অনিরাপদ উপকরণ ব্যবহারে নারীরা ভোগেন সংক্রমণ, চুলকানি, এমনকি বন্ধ্যাত্বের মতো জটিলতায়।
সিলেটের সবুজে ঘেরা চা-বাগানগুলো দেশের অর্থনীতিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তেমনি এসব বাগানের গভীরে বসবাস করা হাজার হাজার নারী চা-শ্রমিক আজও পিছিয়ে রয়েছেন স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক থেকে। বিশেষ করে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও মাসিককালীন সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতার অভাব এখনও প্রকট। দৈনিক সবুজ সিলেট-এর একটি অনুসন্ধান বলছে, সিলেট অঞ্চলের বেশিরভাগ চা-বাগানের নারী শ্রমিক স্যানিটারি ন্যাপকিন সম্পর্কে জানেন না বা কখনো ব্যবহার করেননি। তাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, এটি প্রয়োজনীয় কিছু নয়, বরং লজ্জার বিষয়। এখনো তারা পুরনো কাপড়, পাটের টুকরা বা অন্য অনিরাপদ উপকরণ ব্যবহার করেন, যা থেকে জন্ম নিচ্ছে নানা স্বাস্থ্য জটিলতা।
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অর্থ খরচ, সময় ও আতঙ্ক। ফলে মাসিককালীন ইনফেকশন, চুলকানি, এমনকি প্রজনন ক্ষমতা হারানোর মতো জটিলতা নিয়েই তারা চুপচাপ সহ্য করে যায়।
এ ব্যাপারে কথা বললে চা-শ্রমিক কমিউনিটির নারী শ্রমিক সুমি নায়েক সবুজ সিলেটকে বলেন-আমরা ছোটবেলা থেকে যেটা দেখে এসেছি, সেটাই ব্যবহার করি। দোকানে কী বিক্রি হয় বা সেটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় জানি না। তিনি বলেন- মাসে চার-পাঁচদিন শুধু ব্যথা না, মনে হয় শরীর মাটি হয়ে যাচ্ছে। ভেজা কাপড় পরে কাজ করতে হয়। কাপড় ঠিক মতো শুকায়ও না। কিন্তু কী করবো? স্যানিটারি প্যাড তো আমাদের জন্য নয়। প্রতিমাসে ৫০-১০০ টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমাদের নেই।
এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের সাথে কথা বললে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম রব মাহমুদ শোয়েব সবুজ সিলেটকে জানান - অনিরাপদ মাসিক ব্যবস্থাপনা থেকে সংক্রমণ, বন্ধ্যাত্বসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যার কারণ বেশির ভাগ চা শ্রমিক নারীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন। তাদের জীবন সামাজিক ট্যাবু, লজ্জা এবং শিক্ষা ও তথ্যের অনেক ঘাটতি রয়েছে । অনেকেই কুসংস্কারের কারণে এই বিষয়ে আলোচনা করতেও ভয় পান। স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলাসিতা নয়, এটা একটি অধিকার। আর অধিকার কখনো দূর গ্রামের চা পাতার ঝোপে হারিয়ে যাওয়া কোনো শব্দ হওয়া উচিত নয়।
এ ব্যাপারে সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কর্মরত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো) এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ সবুজ সিলেটকে জানান - বর্তমান এই সময়ে এসেও আমাদের চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর কিশোর-কিশোরীরা তাদের শারীরিক সমস্যা নিয়ে সচেতন নয়। বিশেষ করে এখানকার কিশোরীরা তাদের বয়সন্ধিকালের নানান সমস্যা সম্পর্কে সচেতন নয়। তবে স্থানীয় কিছু বেসরকারি সংগঠন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সচেতনতা বাড়াতে। তারা চা-বাগানে গিয়ে কর্মশালা করছেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করছেন, মাঝে মাঝে ক্যাম্প করে। কিন্তু তা একদিনের জন্য,এখনও পর্যাপ্ত নয়। আর এই মেয়েদের প্রয়োজন প্রতিদিনের শিক্ষা। যার জন্য আমরা আগামীতে তাদের নিয়ে সচেতনতা মূলক প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করবো। চা বাগান এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম না থাকায় তাদের এই অবস্থা। সুতরাং এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিৎ।
এ ব্যাপারে সিলেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো: আনিসুর রহমান বলেন, ‘‘এই জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং সহজলভ্য পণ্য নিশ্চিত না হলে, এই সংকট কাটবে না।"
চা-বাগানের নারীরা দেশের জন্য কাজ করছেন প্রতিদিন, অথচ তাদের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা এখনও নিশ্চিত হয়নি । এই বাস্তবতা বদলাতে এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত পদক্ষেপ। সিলেটের সবুজ চা-বাগান যতোটা সুন্দর, তার ছায়ায় ততোটাই অন্ধকারে রয়েছে হাজারো নারী ও কিশোরীর স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ।