চায়ের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক সফল মায়ের আহাজারি

চায়ের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক সফল মায়ের আহাজারি

সুবর্ণা হামিদ 

ভোর হয় যখন, পাহাড়ের কোলে শিশির জমে, আর চা শ্রমিক মায়েদের চোখে জমে স্বপ্নের অবশিষ্টাংশ। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে তাদের, যেমন তানজিনা বেগমের। আধাবসা ঘরে, সিমেন্ট না-দেয়া মেঝেতে, সামান্য চাল-ডাল ফুটিয়ে তিনি তৈরি করেন এক মুঠো ভালোবাসা, যা হয়তো সন্তানদের পেট ভরায় না, কিন্তু একজন মায়ের হৃদয় ভরিয়ে রাখে। চায়ের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য মায়ের কাহিনি—যাদের অনেকের নাম নেই কোনো কাগজে, নেই কোনো পরিসংখ্যানে। তাদের ব্যথা, ঘামে ভেজা জীবন আর বুকভরা ভালোবাসা কেউ দেখে না।

সবুজ পাতার নিচে সূর্য ওঠে প্রতিদিন, কিন্তু তাদের জীবনে আলো ফোটে না। প্রতিটি পাতার নিচে লুকিয়ে আছে অসংখ্য মায়ের মুখ। তাদেরই একজন চা শ্রমিক মা—তানজিনা বেগম। যার ঘুম ভাঙে ভোরে, খালি পেটে, চিন্তায় ভরা মনে। রান্নাঘরে আধা সেদ্ধ ভাতের গন্ধ আর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ নিয়ে প্রতিদিন শুরু হয় তার লড়াই। ঝুড়ি কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি হাঁটেন সবুজ পাতার মাঝে, অথচ তার চোখে কোনো সবুজ নেই—শুধু রঙহীন অপেক্ষা।

তানজিনা বেগম, বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, তবে তার চোখেমুখে পঞ্চাশেরও বেশি ক্লান্তির ছাপ। তিনি একজন মা—একজন চা শ্রমিক মা, যার জীবন এক দীর্ঘ নিঃশব্দ আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। একটাই স্বপ্ন পেরিয়ে বছরের পর বছর ধরে কাঁচি চালান পাতায় পাতায়। তার মুখে হাসি নেই কারণ তিনি মা। আর একজন মায়ের হাসি কখনো দেখায় না তার ক্লান্তি কিংবা না-পাওয়ার দীর্ঘ হিসেব। তার হাতে কাঁচি চলে ঠিকমতো, পিঠে ঝুড়ি দুলে, কিন্তু কাঁধে যে বোঝা—তা কেউ দেখে না।

তানজিনা দুই সন্তানের জননী। ছেলে তানভীর ইসলাম সিলেট সরকারি কলেজে ডিগ্রি ১ম বর্ষের ছাত্র, আর মেয়ে বিথি আক্তার সাহেবের বাজার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস দশম শ্রেণির ছাত্রী। 

সীমাহীন কষ্ট আর সংগ্রামের মধ্যেও তানজিনা বেগম স্বপ্ন দেখেন—তার ছেলে-মেয়েকে ডাক্তার বানানোর।যাতে তারা বড় হয়ে চা শ্রমিকদের উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা দিতে পারে।

প্রতিদিন ভোরবেলা যখন শিশিরে ভেজা চায়ের পাতার ভেতর দিয়ে তিনি হাঁটেন, তখন ঝুড়ির ভারের চেয়ে অনেক ভারী হয় তার হৃদয়ের বোঝা। চোখে লেগে থাকে ক্লান্তি, তবু বুকের ভিতরে লুকিয়ে থাকে এক অনড় বিশ্বাস—তার সন্তানদের জীবন হবে আলোর সম্ভাবনার।

তিনি চান না তার মতো তার ছেলে-মেয়ের জীবন হোক। তিনি চান না যেন ওদের সকাল শুরু হয় আধা পেট খেয়ে, কিংবা দিন কাটে শুধুই হিসেব কষে—ভাতের, ডালয়ের, স্বপ্নের। তানভীর আর বিথি যেন পাতা তোলার নয়, মানুষ গড়ার কাঁচি হাতে নেয়—এই তার কামনা। সেই স্বপ্নেই তানজিনা হাঁটেন প্রতিটি দিন, সূর্যের আগে, বৃষ্টির ভেতর, কষ্টের নিচে।

তানজিনা জানেন না তারা ডাক্তার হতে পারবে কি না। কিন্তু তবু তিনি থামেন না, পেছনে ফেরেন না। প্রতিটি পাতা কাটার ফাঁকে ফাঁকে তিনি একটু করে সেলাই করেন এক ভবিষ্যতের, যেখানে চা শ্রমিক মায়েরা আর তাদের সন্তানরা বেঁচে থাকবে মর্যাদা নিয়ে। তার ছেলেমেয়েরা শুধু তার নিজের স্বপ্ন নয়—তারা হয়ে উঠুক আশার নাম, হোক আলোর দূত।