সিলেটের স্কুল ও মাদ্রাসায় নেই কোন হিজড়া শিক্ষার্থী পর্ব ৩

সিলেটের স্কুল ও মাদ্রাসায় নেই কোন হিজড়া শিক্ষার্থী পর্ব ৩

সুবর্ণা হামিদ

দেশের শিক্ষানীতি ও নীতিমালায় বলা আছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার অধিকার সকলের জন্য—যে কোনো লিঙ্গ বা পরিচয়ের মানুষ সমানভাবে শিক্ষা পাবেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। সিলেটের সরকারি ও বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসায় বর্তমানে হিজড়া শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নেই। স্থানীয় হিজড়া কমিউনিটির সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, তারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সুযোগ পায় না।

এ বিষয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বললে

কারিশমা তানহা নামের এক সদস্য বলেন- ছোটবেলায় তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচয় প্রকাশিত হলে পরিবেশ পাল্টে যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনেকে কটূক্তি করতে শুরু করে, কেউ হাসাহাসি করত, আবার কেউ ক্লাসে বসতে দিতে চাইত না। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাকে। তার ভাষায়,আমরা তো শিক্ষার্থী হয়েই স্কুলে যাই, কিন্তু সবার আচরণে মনে হয় আমরা যেন অচেনা। শিক্ষকেরা চুপ থাকেন, কর্মচারীরা হাসাহাসি করেন। এই অপমান সহ্য করা যায় না।

আরেকজন সদস্য রবিউল ইসলাম সাজু জানান- তিনি মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। ভর্তি ফরমে লিঙ্গ পরিচয়ের ঘরে কী লিখবেন, তা নিয়েই প্রশাসন জটিলতা তৈরি করে। অনেকে তার পরিচয় স্বীকার করতেই নারাজ ছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা চাই পড়াশোনা করতে, সমাজের অন্যদের মতো স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের মেনে নিতে চায় না। ফলে আমরা শিক্ষার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হই।

শুধু স্কুল নয়, মাদ্রাসাগুলোতেও একই পরিস্থিতি। মাদ্রাসার শিক্ষক ও প্রশাসকরা স্বীকার করেছেন, তারা কখনো হিজড়া শিক্ষার্থীকে ভর্তি করার অভিজ্ঞতা পাননি। অনেকে মনে করেন, সমাজে হিজড়াদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে পরিবারগুলো সন্তানকে প্রকাশ্যে মাদ্রাসা বা স্কুলে পাঠাতে চায় না।

এ বিষয়ে খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন -আমাদের বিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। গত কয়েক বছরে আমরা এ ধরনের কোনো আবেদনও পাইনি। আসলে এদের পরিবার থেকেই অনেক সময় সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় না, আবার সামাজিক নানা কারণে তারাও বিদ্যালয়ে আসতে আগ্রহী হয় না। আমরা যদি কখনো কোনো হিজড়া শিক্ষার্থীর আবেদন পাই, তবে তাকে স্বাভাবিক নিয়মেই ভর্তি করানো হবে। শিক্ষা সবার অধিকার—এই নীতি থেকে আমরা সরে যাই না। কিন্তু সামাজিক সচেতনতার অভাব আর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাস্তবে এখনো তারা বিদ্যালয়ে আসছে না। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই, বরং আমরা চাই সবাই স্কুলে আসুক এবং পড়াশোনা করুক।

এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন-হিজড়াদের জন্য শিক্ষা যেন সোনার হরিণ। তাদের শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি এখনো অনেক কঠিন বাস্তবতা। স্কুল বা মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া তাদের জন্য সহজ নয়, বরং মৌলিক মানবিক চাহিদাই যখন পূরণ হয় না, তখন শিক্ষার সুযোগ আরও দূরের স্বপ্ন হয়ে যায়। হিজড়া কমিউনিটির অনেকেই এ বিষয়ে উদাসীন থাকলেও বাস্তবতা হলো—বিদ্যালয়ের পরিবেশ তাদের জন্য মোটেও শিক্ষাবান্ধব নয়। ভর্তি হতে গেলেই তারা তাচ্ছিল্য আর বৈষম্যের শিকার হন, ক্লাসে থাকলেও নানা সময় হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে মূল কারণ হলো সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালার অভাব এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতার ঘাটতি। ফলে সরকারের অঙ্গীকার সত্ত্বেও হিজড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অধিকার এখনো বাস্তবে নিশ্চিত হয়নি।

এ বিষয়ে মদন মোহন কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল লে. কর্নেল (অব.) এম আতাউর রহমান পীর বলেন - আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও একটি বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। স্কুল বা মাদ্রাসায় আমরা হিজড়া শিক্ষার্থীদের দেখতে পাই না। অথচ শিক্ষা হলো সবার মৌলিক অধিকার। লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ বা সামাজিক পরিচয় যাই হোক না কেন—প্রত্যেক শিশুরই সমানভাবে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে হিজড়া শিশুরা নানা কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়—কখনো সামাজিক অবহেলা, কখনো বৈষম্য, আবার কখনো পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের অনীহার কারণে। এর ফলে তারা মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা তাদের জীবনে দারিদ্র্য ও অসহায়ত্ব বাড়ায়।

আমাদের দায়িত্ব হলো স্কুল-মাদ্রাসার দরজা হিজড়া শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা, তাদের পড়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সম্মানের সাথে পাশে দাঁড়ানো। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই, তবে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে তা কখনো সম্ভব নয়।

সিলেটের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অভিজিৎ কুমার পাল বলেন-সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের সমানভাবে শিক্ষার অধিকার রয়েছে। শুধু হিজড়া জনগোষ্ঠী নয়, সব প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্যই স্কুল ও মাদ্রাসার দ্বার উন্মুক্ত। শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার—এখানে বৈষম্যের কোনো জায়গা নেই।

তবে বাস্তবে হিজড়া শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। এর প্রধান কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা ও পরিবারের অনীহা। অনেকে সমাজে উপহাসের ভয়ে সন্তানকে লুকিয়ে রাখে, আবার বিদ্যালয়ের ভেতরেও সহপাঠী ও শিক্ষকের আচরণ তাদের নিরুৎসাহিত করে।

তিনি আরো বলেন- আমরা নীতিগতভাবে প্রস্তুত—কোনো হিজড়া শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চাইলে স্বাভাবিক নিয়মেই তাকে ভর্তি করানো হবে। কিন্তু কেবল ভর্তি নয়, তাদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখাও জরুরি। এজন্য শিক্ষক ও সমাজকে মানসিকভাবে আরও সচেতন হতে হবে, তাহলেই প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

সব মিলিয়ে চিত্র স্পষ্ট—সিলেটের স্কুল ও মাদ্রাসায় এখনো কোনো হিজড়া শিক্ষার্থী নেই। অথচ সরকারি কাগজে-কলমে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলা আছে। হিজড়াদের স্বীকৃতি পাওয়ার এক দশক পরও বাস্তবে শিক্ষার মূল স্রোতে তারা অনুপস্থিত। তাই প্রশ্ন উঠছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কতটা বাস্তব আর কতটা কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ?