পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চর্যের একটি হ্যালং-বে
লেখকঃ লিটন দাশ গুপ্ত
সেই দিন ছিল ডিসেম্বরের ২ তারিখ। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় শহরের ৫ তারা হোটেল ‘ল্যাসুইট’ এর ৫০৪ নং কক্ষে সাড়া রাত ঘুম হয়নি। আর এই ঘুম না হবার প্রথম কারণ হচ্ছে, পরের দিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ইং তারিখে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চার্যের একটি হ্যালং বে দেখতে যাবার কথা। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, হ্যানয় শহরের প্রতি শুক্রবার রাতে, অলিগলিতে স্ট্রিট মার্কেট হয়ে থাকে। আর এইদিন অর্থাৎ ২ তারিখ শুক্রবার অনেক রাতধরে স্ট্রিট মার্কেট ঘুরলাম। এই দিকে সিদ্ধান্ত হয়, হোটেলের সামনে সকাল ৭টায় আমাদের জন্য গাড়ি আসবে হ্যালংবে’র যাত্রার উদ্দেশ্যে। ৭টা মানে বাংলাদেশী হিসাবে নয়, ভিয়েতনামী হিসাবে ৭টা; অর্থাৎ ৭.০১ মিনিটও হতে দেয়া যাবে না; তাই সকল মানসিক চাপ, উত্তেজনা, আনন্দে ঘুম না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
পরদিন ৩ তারিখ আমরা যথাসময়ে হোটেলের নীচে এসে দেখলাম, বিলাস বহুল বিশাল এক গাড়ি যথাসময়ের আগেই চলে এসেছে। গাড়ির সাথে আছে নবাগত গাইড লুচিপ্যাম। দেরী না করে সবাই গাড়িতে উঠে পড়লাম। হ্যানয় থেকে হ্যালং বে’র দুরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। আমরা গাড়িতে উঠার পর যথাসময়ে গাড়ি ছাড়ল। দুইজন ড্রাইভার পালক্রমে গাড়ি চালাচ্ছে। একজনের একটানা ১৮০ কিলোমিটার পথ গাড়ি নিয়ে পাড়ি দিতে মন:সংযোগ বা অন্যকোন রকম সমস্যা হতে পারে, তাই দুইজন ড্রাইভার, কি অদ্ভুদ ব্যাপার!
গাড়ি চলছে শহর পেরিয়ে গ্রামের পথ দিয়ে; দুর থেকে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজি ক্ষেত, ধানক্ষেত, কিছুদুর পর-পর বাড়িঘর। দুর থেকে আরো খানিক দূরে যাবার পড়ে দেখতে পাচ্ছি, সবুজ পাহাড়ের সাথে নীলাকাশের মিতালী, আহা কি সুন্দর পরিবেুশ! এরই মধ্যে কয়েকজন বন্ধু গান শেষ করে ফেলল, আর একজনে গান ধরল- এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলতো....... । সত্যি যেন এই পথ শেষ না হলেই ভালো হত।
আমাদের রিজার্ভ করা বিলাস বহুল গাড়ি, তারপরেও মধ্যপথে ২৫/৩০ মিনিটের বিরতি। দুইজন চালক আছে, কিন্তু এই বিশ্রাম চালক বা যাত্রীর জন্যে নয়, গাড়ির ইঞ্জিনের জন্যে বিশ্রাম।
যাহোক, বিরতিতে যেখানে গিয়ে গাড়ি থামল সেখানে দেখলাম, শতশত হাজারো হাজারো বিভিন্ন ধরনের গ্রাফাইট, মার্বেল পাথরের মূর্তি, পথে ঘাটে পুরো এলাকা জুড়ে ৩/৪ ফুট থেকে শুরু করে ১৩/১৪ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট বিভিন্ন রকমের মূর্তি বা ভাস্কর্য। সবাই দেখে অবাক আমিও অবাক হয়ে নির্বাক হয়ে গেছি। এখানে শতশত পর্যটক, প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ সবাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ছবি উঠালাম। সামনে বড় একটা মার্কেট ছিল সেখানেও গেলাম। তারপর আবার গাড়িতে উঠে বসলাম, গাড়ি চলছে আর পুরো পথ ধরে ভিয়েতনামের কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে বলে যাচ্ছে গাইড ওভারস্মার্ট লেডি লুচিপ্যাম। আমাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, মাঝে মধ্যে চলছে গান, এমন কি লুচিপামের নৃত্য।
এখানে কথা অনেক বলে ফেলেছি, কিন্তু কেন ভিয়েতনাম গেলাম, ভিয়েতনাম যাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কিছুই বলা হলনা আমার। ভিয়েতনাম যাবার মূল কারণ হচ্ছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায়, ‘ট্রেনিং কাম ষ্ট্যাডি ট্যুর’ এর আওতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও দেশ ভ্রমণ, আর আমরা গিয়েছি পুরো একটি টিম। আমাদের সাথে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব, পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, পিটিআই সুপারইনটেনডেন্ট সহ উর্দ্ধতন ১৬ জন কর্মকর্তা, ১২ জন শিক্ষক। সবমিলে মোট ২৮ জনের টিম।
যাহোক, আমরা কথা ও গানে, ছন্দে ও আনন্দের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কুয়াংনি প্রদেশের হ্যালংবে জেটিতে। আশে পাশে দালান গুলো দেখলাম আকর্ষনীয়, হোটেল মোটেল রেস্টুরেন্ট পর্যটকদের জন্যে চারিদিকে যথাযথ সুব্যবস্থা।
আমরা কিছুক্ষণ ওয়েটিং প্লেসে বসলাম, এরপর পিরোজপুরের বন্ধু সঞ্জয় কুমার মালঙ্গী, চুয়াডাংগার বন্ধু শোয়াইব হোসাইনকে নিয়ে জেটির আসে পাশে ঘুরতে ও দেখতে গেলাম। আশে পাশে হাজার হাজার পর্যটকের ভীড়ের মধ্যে দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। এ সময় বন্ধু শোয়াইব আমাকে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করে আমি নির্বাক ও আনমনা হয়ে গেলাম কেন? আমি তাকে আমার মনের ভাব বুঝার জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আসলে ঠিক এই মূহুর্তে আমার কিছুটা মন খারাপ, আর এই জন্যেই আমি কিছুটা নির্বাক। বিষয়টি বন্ধুদের খুলে বললাম, সুন্দরবনকে সপ্তম আশ্চার্যের অন্তর্ভুক্তির জন্য নিজে ভোট দিলাম, বিভিন্ন সংগঠন ও বন্ধুদেরকে ভোট দিতে উৎসাহিত করলাম। অনেক চেষ্টা করেছিলাম অগাধ বিশ্বাস নিয়ে, কারণ ভারত বাংলাদেশের একশ বিশ/ ত্রিশ কোটি মানুষ। তাই দুই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক ভোটে সুন্দরবন সপ্তম আশ্চর্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। আজ সেই জায়গাটি দেখতে এলাম, যে জায়গাটি আমাদের সুন্দরবনকে পরাজিত করে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চর্যরূপে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। সেই দিনের এই পুরানো কথা মনে পড়াতেই একটু খারাপ লাগছে। বিষয়টি তারাও অনুধাবন করতে পারল।
এরই মধ্যে গাইড লুচিপ্যাম আমাদের জন্যে হ্যালং বে’র প্রবেশ টিকিট ও প্রমোদতরী রিজার্ভ করে নিয়ে চলে এল। একইসাথে গাইড আমাদের সবাইকে দ্রুত প্রমোদতরীতে উঠে যাওয়ার জন্যে আহ্বান জানালো। প্রমোদতরীতে উঠে দেখলাম, এটি তরী নয়, চেয়ার টেবিল সাজানো যেন একটি ছোট খাটো কনফারেন্স রুম। যার যার ইচ্ছামত সিটে বসলাম সবাই, আবার টীমের মধ্যে জনগণনা করে নিল আমরা ২৮ জন আছি কিনা। শুধু এখানে নয় আমাদের পুরো ভিয়েতনামে বা রাজধানী হ্যানয় শহরে প্রতিবার গণনা করে নিতে হত ও সাবধানে থাকতে হত। হারিয়ে গেলে কিন্তু বিপদ। শুধু বিপদ নয় মহাবিপদ বলা যেতে পারে। কারণ পুরো ভিয়েতনামে তাদের নিজস্ব ভিয়েতভাষা ছাড়া, অন্যকোন ভাষা এমনকি আন্তর্জাতিক ইংরেজী ভাষারও ব্যবহার নেই। উল্লেখ্য, প্রাথমিক থেকে শুরু করে কোন শিক্ষাস্তরে বা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজী বিষয় বা শিক্ষাক্রম নেই। বিভিন্ন কারনে ইংরেজী ভাষাকে প্রত্যাখান করে আসছে ভিয়েতনামবাসী। তাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, অফিস আদালত কোথাও ইংরেজী বর্ণের লেখা বা কোথাও কোন ইংরেজী ভাষার কথা নেই, এমনকি সেখানকার উর্দ্ধতন কর্মকর্তাও ইংরেজী ভাষা বুঝেননা। আগের দিন রয়েলসিটি মেঘামলে বন্ধু শোয়াইব হারিয়ে যাওয়া ও সন্ধান পাওয়া বিষয়ে সকলের হাড়ে হাড়ে জানা আছে। উল্লেখ্য ‘রয়েলসিটি মেঘামল’ হচ্ছে এমন এক বিশাল মার্কেট, যেখানে ঢাকার বসুন্ধরার মত কয়েকটি মার্কেট, এই মেঘামল নামক মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ডে আছে। এক একটা দোকানের আয়তন আমাদের দেশের এক একটা মার্কেটের সমান। আর এই মার্কেটে বয়সের দিক দিয়ে প্রায় হাফসেন্সুরী করা বন্ধু শোয়াইব হারিয়ে যাওয়া ও শিশুর মত কান্না টিমের সকলের মনে আছে ও থাকবে।
যাহোক, এরইমধ্যে আমাদের প্রমোদতরী তরিগরি করে চলতে শুরু করেছে। মিনিট ৭/৮ যেতেই কি অপূর্ব দৃশ্য। পানির ভিতর থেকে উঠে এসেছে পাহাড়। পাহাড়ের সামনে দিয়ে আমাদের তরী বয়ে যাচ্ছে। যে পাহাড়গুলো অপেক্ষাকৃত অধিকতর আর্কষণীয় সেগুলো গা ঘেষে ভেসে যাচ্ছে তরী। যতদুর দৃষ্টি যায় এই দৃশ্য দেখতে পায়, যেন দুর আকাশে পাহাড় পানির মিতালী। এটি আয়তনে কত, কখন সৃষ্টি, কিভাবে সৃষ্টি হাজারো প্রশ্ন আমাদের। সাথে থাকা গাইড লুচিপ্যাম উত্তর দিচ্ছে।
গাইড লুচিপ্যাম থেকে জানতে পারলাম ‘হ্যালংবে’ এর আয়তন ১৫৫৩ বর্গ কিলোমিটার। স্বচ্ছ নীল পানিতে যে সবুজ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে, সে গুলো প্রকৃতিগতভাবে চুনাপাথরের তৈরী, আর এগুলোর সংখ্যায় প্রায় দুইহাজারের মত। গবেষণায় দেখা গেছে, এইগুলো সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চাশ কোটি বছর আগে। আর পঞ্চাম কোটি বছর পূর্বে সৃষ্ট কথাটি শুনে অনেকের চোখ কপালে উঠল।
হ্যালংবে -তে নাকি ৯২৮টি দ্বীপ রয়েছে। এছাড়া চারটি ভাসমান গ্রাম রয়েছে, গ্রামের সবাই মৎস্যজীবি। এই উপসাগরে চৌদ্দ প্রজাতির ফুল, দুইশত প্রজাতির মাছ রয়েছে, এবং প্রায় সাড়ে চারশ প্রজাতির মত শামুক ঝিনুক জাতীয় প্রাণী রয়েছে। জানা যায় এখানে মানুষ বসবাস শুরু হয়েছে হাজার দশেক বছর আগে। আর এই হ্যালংবে’কে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
যাহোক, গাইড এভাবে তথ্যসমৃদ্ধ কথা বলছে, এতই সাথে আমাদের প্রমোদতরীও চলছে। এটা প্রমোদতরী বলছি এজন্যে- ষ্টিমার, বোট, লঞ্চ, কোনটার সাথে এটির সাদৃশ্যতা নেই, তাই বন্ধুরা প্রমোদতরী নামে চিহ্নিত করল। আর নীল পানি পথে এই প্রমোদতরী চড়ে একের পর এক সবুজ পাহাড়, দেখে দেখে যাচ্ছি উপভোগ করছি। কি বিস্ময়কর দৃশ্য! যেন পানি নয়, পাহাড় নয়, ধরার ধুলিতে নেমে আসা স্বর্গীয় এক কন্যা যাকে বলাহয় অপ্সরা।
ভিয়েতনামী ভাষায় হ্যালং শব্দের অর্থ মাটিতে বা ভুমিতে নেমে আসা ‘ড্রাগন’। এই সম্পর্কে লুচিপ্যাম সংক্ষেপে একটি গল্প শুনালেন। গল্পটি হচ্ছে এই রকম- ভিয়েতবাসীরা মনে করেন, পুরাকালে এই অঞ্চলের মানুষের সাথে দস্যুদের সবসময় যুদ্ধ লেগেই থাকত। তখন নিরীহ ভালো মানুষকে রক্ষা করতে ঈশ্বর একটি ‘ড্রাগন’ পরিবার প্রেরণ করেন। আর এই ড্রাগনদের থু-থু থেকে, এই উপসাগরে হাজারো হাজারো মনিমুক্তা সৃষ্টি হয়। দস্যুরা তখন স্বচ্ছ, সুন্দর ¯িœগ্ধ মূল্যবান মনিমুক্তা দেখে মুগ্ধ হয়ে, জাহাজ করে আনতে গেলে, যাদুকরী পাহাড়ের সাথে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা লেগে সেখানেই তারা একেরপর এক ধ্বংস হতে থাকে। এইভাবে পুরো এলাকা রক্ষা পায়, শান্তি ফিরে আসে। এরপর ড্রাগন পরিবার এমন সুন্দর স্বর্গীয় পরিবেশে একেবারে থেকে যেতে ইচ্ছে পোষন করেন, এবং ঈশ্বরের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাদের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে এই ড্রাগন পরিবারকে থাকার অনুমতি দিলেন। অবশেষে এই ড্রাগন পরিবারের মা ড্রাগন যেখানে ছিলেন, সেটার নাম ‘হ্যা-লং’ শিশু ড্রাগন যেখানে ছিল সেইটির নাম ‘বাই-তু-লং’।
এরই মধ্যে ময়মনসিংহের বন্ধু বোরহান উদ্দীন, মাদারীপুরের বন্ধু মুসফিক এবং চুয়াডাংগার শোয়াইব সহ আরো কয়েকজন মিলে তরীর উপরে এক ঝলক নৃত্য পরিবেশন করে ফেলল গাইড লুচিপ্যাম এর সাথে। যদিও জয়পুরহাট জেলার বন্ধু, আমার হোটেলের রুমম্যাট কমলেন্দু সান্যাল এই নাচের ধরণ ও পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা করে আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল আমি সরাসরি নাখোশ করে দিয়ে বলি, অসুবিধা কোথায়? আমি আপনি পারিনা, এরা পারে। মানুষকে প্রশংসা করতে শিখেন উৎসাহ দিতে চেষ্টা করেন। এখানে প্রশিক্ষণের সাথে সাথে আনন্দ করার জন্যে এসেছি।
এখানে আর একটি কথা বলে রাখি, লুচিপ্যাম আমাদের রোমাঞ্চ করে ‘আই লাভ ইউ’ বাংলায় অনুবাদ করে দিতে বলেন, আমরা বলে দিলাম ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এর বিনিময়ে ‘আই লাভ ইউ’ কে ভিয়েতভাষায় অনুবাদ করে দিলেন ‘থই ইও বান’। এই অবস্থায় প্রতিটা সময় একজন আর একজনকে কথায় কথায় থই ইও বান শব্দটি শতশত বার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে গল্প, নাচ, গান শুনতে শুনতে আমরা চারিদিকে দেখতে থাকি, সত্যি কথা বলতে গেলে আমরা গল্প শুনার চেয়ে দৃশ্য দেখার মনোনিবেশ ছিলাম বেশী। এই অবস্থায় গাইবান্ধা জেলার ডিপিইও জনাব আমিরুল ইসলাম মহোদয় ইংরেজী ভাষায়, রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া এই গাইড, আমাদেরকে সুন্দর ভাবে এই সকল তথ্য জানানোর জন্যে ধন্যবাদ দিলেন। বেশ খুশি হয়ে গেলেন গাইড লুচিপ্যাম। এরপর ডিপিইও মহোদয় বাংলাভাষায় বলেন, বেটি তুই গাড়িতে পুরো রাস্তায় বকবক করে জ্বালায় খায়ছোস আর এখন, এমন আশ্চর্য জায়গা দেখতে এলাম এখানেও তোর বকবকানি, শান্তি নেই। এ কথা গুলো শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। একই সাথে গাইড লুচিও আমাদের সাথে হাসতে লাগল। আমরা বাংলা বুঝে হাসলাম অন্যদিকে গাইড না বুঝে হাসল। এতে করে সবার মধ্যে আরো হাসির উদ্রেক হল। অধিদপ্তরের পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম স্যার বলেন, ডিপিইও আমিরুল ইসলাম মহোদয়ের মত কর্মকর্তা সফরসঙ্গী হওয়ায় ভ্রমন জমে উঠেছে।
যাক, এভাবে চলতে চলতে, নানান কথা বলতে বলতে, হ্যালংবে এর অপরূপ অপূর্ব ও অভূতপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতেই লাগলাম। এই উপসাগরে পানির মাঝে কোথাও চুনাপাথরের বড় পাহাড়, কোথাও ছোট পাহাড়, কোথাও সুউচ্চ পাহাড় আবার কোথাও কোথাও কোন কোন স্থানে দুটি পাহাড় এমন ভাবে আছে, দেখে মনে হয় পর্যটকদের স্বাগত জানাতে, অনুষ্ঠানে প্রবেশ পথে চুনাপাথরের কারুকার্যে সাজানো তোরণ বসানো হয়েছে, আর আমরাও তোরণের ভিতর দিয়ে সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে প্রবেশ করছি। আবার কিছু পাহাড়ের পাদদেশ ক্ষয়ে সরু হয়েগেছে আর শীর্ষঅঞ্চল এত বড়, দেখে মনে হয় এখনই ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের শব্দহীন প্রমোদতরী পাহাড়গুলোর কাছ দিয়ে ছুটে চলেছে। এরই মধ্যে আমরা বড় বড় চিংড়ি ফ্রাই ও হাফসিদ্ধ সব্জি দিয়ে ভাত খেয়ে ফেললাম। ভালো ভাবেই ভাত খেয়ে নিলাম, কারণ অনেক দিনপর ভিয়েতনামে আমরা ভাত খাবার সুযোগ পেলাম।
যাহোক, প্রমোদতরী নাম রাখা এই জাহাজের ছাদে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম কৃত্রিম সবুজ ঘাস বিছানো পুরো ছাদ। এত সুন্দর দেখতে আমাদের অনেকক্ষণ সময় লেগেছে প্রকৃত দূর্বাঘাস নাকি কৃত্রিম দূর্বাঘাস তা বুঝতে। আমরা উপরে বসলাম, ছবি উঠালাম। এই দিকে ছোট ছোট বোট করে সেই দেশের মহিলারা ফল, সবজি, কসমেটিক্স সহ বিভিন্ন রকমারী জিনিষপত্র বিক্রি করছে। একটি পর্যটকবাহী তরী দেখলে দ্রুত চলে আসছে কয়েকটি চারকোণা আকৃতির এই নৌকা। আগেই বলেছি এরা ইংরেজী ভাষাকে প্রত্যাখান করেছে, বোটে করে ভাসমান দোকানীদের সাথে হাতের ইশারার মাধ্যমে বেচাকেনা, দরকষাকষি ইত্যাদি মজাটায় আলাদা। সুনামগঞ্জ জেলার ডিপিইও জনাব হযরত আলী মহোদয় টীমের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বর্ষীয়ান ছিলেন। তিনি কি কিনবে, কত টাকা দর করতে হবে প্রতিটিক্ষণ আমার সাথে পরামর্শ করতেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশের ১ টাকায় ভিয়েতনামের ২৭৩ ডং (ভিয়েতনামের মুদ্রার নাম ডং যেমনই আমাদের দেশের মুদ্রার নাম টাকা) সেই হিসাবে আমরা সবাই সেই দেশের কোটিপতি ছিলাম। আর খরচের বিষয়টি আরো মজার। যেমন সেই সময় একটি পেয়ারা কিনেছি সাড়ে ৭ হাজার টাকা, একটি আম ২৯ হাজার টাকা, একটি আধা লিটার পানির বোতল সাড়ে ৮ হাজার টাকা, একটি ব্লেড ১৫শ টাকা। উল্লেখ্য যাবার সাথে সাথে সেই দেশের একটি সীম কিনলাম আড়ায় লাখ টাকা দিয়ে, আর বাংলাদেশে প্রতি মিনিট কথায় খরচ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া স্ত্রী’র জন্যে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ কিনলাম, ছয় লাখ আশি হাজার টাকা দিয়ে। স্ত্রী’র ব্যাগটির কথা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, ভিয়েতনাম থেকে আসার পর অধিকাংশ মানুষের প্রশ্ন ছিল, বৌয়ের জন্যে কি এনেছি। তাই অধিকাংশ মানুষের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম। এখানে আরো একটি কথা উল্লেখ করি, আগেই বলেছি প্রমোদতরীতে আমরা ভালোভাবে ভাত খেয়েছি, এই ভালোভাবে খাবার কারণ হচ্ছে সেখানে ভাতের সংকট। আমরা একদিন ইন্ডিয়ান হোটেলে বাঙ্গালী খাবার ভাত খাওয়ার জন্যে গিয়েছি। আর সেখানে জনপ্রতি যাতায়ত খরচ পড়েছে ষাট হাজার টাকা; মুরগীর মাংস দিয়ে ডাল, সবজি ভাত খরচ পড়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
এরই মধ্যে শেষ বিকালের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আমরাও গানে গানে, সুরে সুরে পানি পথে দুরে দুরে এমন দৃশ্য ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এভাবে চলতে চলতে হ্যালংবে’র একটি তীরে এসে আমাদের তরী ভিড়ল। এবার এখানে একটি গুহা দেখতে যাবার কথা। কিন্তু তখনও আমরা বুঝতে পারিনি, গুহার ভিতর এমন অপূর্ব অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। হ্যালংবে’র তীরে সুউচ্চ পাহাড় বেয়ে আমরা উঠতে লাগলাম। মতিউর রহমান স্যার (অতিরিক্ত সচিব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়) আমাকে বললেন, আমরা দুজন এখানে (নিচে) বিশ্রাম নিই, এত উপরে উঠে গুহায় কিআর দেখব? আমি বলেছি, ভিয়েতনামে হয়ত আর আসা হবেনা, একটু কষ্ট করে হলেও উঠে দেখি কি আছে, আমি মতিউর রহমান স্যারকে প্রয়োজনে সাহায্য করব বলে উনাকে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে উঠতে থাকি ।
পাহাড়ের উপর উঠলাম, গুহার ভিতর ঢুকলাম। সবাই অবাক, আমরা যারা সবাক ছিলাম এখন সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম, কোথায় এলাম! মানুষ যে বলে স্বর্গ বা বেহেশত, তাহলে কি এটাই সেই স্বর্গ? লাখো বছর আগে বিবর্তনে প্রকৃতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সৃষ্ট এই গুহার ভিতর কত বৈচিত্রের পরিবেশ। গুহার ভিতর দেয়ালে বিভিন্ন আকৃতির গাছপালা পশুপাখি। প্রায় ৭/৮ তলা ভবনের সম উচ্চতা বিশিষ্ট বিশাল বিশাল গুহার দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন জীবজন্তু, নরনারীর খোদাই করা বিভিন্ন আকৃতির দৃশ্য। তাও আবার মানব সৃষ্ট কৃত্রিম নয়, প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালে সৃষ্ট সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক চিত্র। গুহার ভিতর বেগুনী, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল এই সপ্তরঙে নয়, কত শত রঙে সাজানো হয়েছে মৃদু বা হাল্কা আলো দিয়ে। গুহার উপর ও বিভিন্ন পাশদিয়ে বিন্দু বিন্দু জল নিচে পড়ে, গড়িয়ে যাচ্ছে অতি চিকন সরু আকৃতির ঝর্ণাধারার মত পানির ¯্রােত। অবশেষে মতিউর রহমান স্যারকে বললাম, আজ এখানে না আসলে কেমন হত, বিরাট অপূর্ণ থেকে যেত।
সাইনবোর্ডে ভিয়েতভাষায় লেখা শব্দ বা বাক্যগুলো পড়া যাচ্ছেনা, তবে জানতে পারলাম; এই গুহার নাম ‘ডংতিয়েনচুং’। এই রকম নাকি এই হ্যালংবে’র তীর এলাকার আশেপাশে শতাধিক গুহা রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় গুহাটির নাম ‘হাংডুগো’।
এরপর গুহা থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত আকাশ, স্বচ্ছ বাতাস গ্রহন করে একে একে সারিবদ্ধ এসে উঠে পড়লাম অপেক্ষমান প্রমোদতরীতে। যাবার সময় যে তরীর ধীর গতি ছিল, এখন তরীর গতি অতি দ্রুত। ঠিক যে জায়গায় প্রথম জেটি হতে প্রমোদতরীতে উঠেছি ঠিক সেই জায়গায় জেটিতে নেমেছি। কিছুদুর হেঁটে গিয়ে আমাদের বিলাসবহুল বিশাল গাড়িটি আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে জেটি সংলগ্ন টার্মিন্যালে। একে একে সবাই উঠে পড়লাম, গাইড প্রতিবারের মত গণনা করে নিল। সব ঠিক আছে তাই গাড়ি ছুটে চলল, গাড়িতে গান গল্প ভ্রমন নিয়ে আলোচনা শেষে, চলে এল মাঝপথের বিরতি। এবার কিন্তু মূর্তির বাগানে নয়, মুক্তার বাজারে। সবাই অবাক, এত বড় মুক্তোর মার্কেট হতে পারে! সেখানে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। মার্কেট বলতে ২/৩ তলা বিশিষ্ট ১২/১৩ হাজার বর্গফুটের বিশাল স্বচ্ছ গ্লাসে আবদ্ধ অ্যাপার্টমেন্ট । এর বাইরে চতুর্দিকে যতদুর দেখা যায় হাঁটু সমান পানিতে ডুবা জমি, যেখানে ঝিনুক চাষ করা হয়।
ঝিনুক থেকে কিভাবে মুক্তা সংগ্রহ করা হয়, পুরো প্রক্রিয়া আমাদের দেখালো মাকের্ট কর্তৃপক্ষ। দেখানো মানে শুধু দেখা নয়, সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করলাম। এভাবে পর্যটকদের বিশ্লেষণ করে পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করানো মার্কেট কর্তৃপক্ষের নাকি এক ধরনের বিজ্ঞাপন। অবাক হলাম লক্ষ লক্ষ ঝিনুকের স্তুপ দেখে। ট্রের মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থে ঝিনুক ডুবিয়ে অজ্ঞান করে, একটি একটি হাঁ করিয়ে চিমটি দিয়ে ঝিনুকের পেট থেকে মুক্তা বের করে আনা পুরো প্রক্রিয়া আমরা দেখে অভিভুত হলাম। দেখে ঝিনুকগুলো মরে গেছে মনে হচ্ছিল, কিন্তু না বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে মুক্তা সংগ্রহের পর খোলস বন্ধ করে আবারো উন্মুক্ত করা হয় পাশের ঝিনুক চাষের জমিতে। অনেকক্ষণ দেখার পর আবারো যথারীতি গাড়িতে উঠে বসলাম। গান গল্প নৃত্য অভুতপূর্ব দৃশ্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে চলে এলাম ল্যাসুইট হোটেল ৫০৪ নং কক্ষে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছি। এরপর কি রাতের খাবার, মানে ভাত? না এত সহজে তা সম্ভব নয়। সাথে করে ভিয়েতনামে নেয়া শুষ্ক খাবার ও কফি বিস্কুট জাতীয় হাল্কা খাবার সেরে সাজসজ্জা বিশিষ্ট কক্ষে শয্যায় গেলাম। ক্লান্ত দেহে দ্রুত ঘুম, তবে ঘুমের আগে যেন জাগা অবস্থায় স্বপ্ন! না কোন স্বপ্ন নয় কবির কথাই ভাবলাম, সার্থক জনম মোর জন্মেছি এই দেশে, আমার কথায় ভাবলাম সার্থক জীবন মোর গিয়েছি সেই দেশে।
লেখকঃ লিটন দাশগুপ্ত (শিক্ষক ও সাহিত্যিক)