যুক্তরাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে
ড. আজিজুল আম্বিয়া
সম্প্রতি সংসদ ভেঙে দিয়ে যুক্তরাজ্যে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। দেশটিতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সুনাক এ বছরের ৪ জুলাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে ।সংবাদমাধ্যম বিবিসির মাধ্যমে জানা যায় , নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে মন্ত্রীদের এ ব্যাপারে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এরপর তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময়ে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দেশের নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের আগে রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছে যান তিনি। সেখানে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও নতুন নির্বাচন আয়োজনের জন্য রাজার অনুমতি চান তিনি। রাজা চার্লস অনুমতি প্রদানের পরেই এটি জনসম্মুখে ঘোষণা করেন তিনি। ধারনা করা হচ্ছে,
যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ১০৭টি কাউন্সিলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধী দল লেবার পার্টির কাছে ব্যাপক ধরাশায়ী হয় ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, হয়তো এ কারণেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। গত নির্বাচনে স্যার কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল । বলা যায়, বিগত ৪০ বছরে এবারই কনজারভেটিভ পার্টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমন ধরাশায়ী হল। এদিকে যুক্তরাজ্যের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পাননি দলটির সাবেক প্রধান জেরেমি করবিন। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বরাবরের মতো লন্ডনের ইসলিংটন নর্থ আসন থেকে নির্বাচন করবেন করবিন। এতে ওই আসনে পরাজয়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে লেবার পার্টি। করবিন ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত লেবার পার্টির নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বেই ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয় লেবার পার্টি। সেই দল থেকে ২০২০ সালে করবিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনের ইসলিংটন নর্থ আসন থেকে জয় পেয়ে আসছেন করবিন। লেবার পার্টির প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম না দেখে তিনি
নির্বাচন করার ঘোষণা দেন তিনি। করবিন বলেছেন, ‘সাম্য, গণতন্ত্র ও শান্তির পক্ষে একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ওই আসন থেকে নির্বাচন করবেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি চাই, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেন গণতান্ত্রিক হয়। তবে ইসলিংটন নর্থে লেবার পার্টির সদস্যদের নিজেদের (পছন্দের) প্রার্থী বেছে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী করবিন বলেন, ‘আমাদের একটি পদক্ষেপ নিতেই হতো। সোচ্চার হয়ে বলতেই হতো, আমরা এটা আর মেনে নিতে পারছি না। আমরা নিজেদের অধিকার আদায় করেই ছাড়ব। এ কারণেই ইসলিংটন নর্থের মানুষের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।১৯৮৩ সাল থেকে ইসলিংটন নর্থ আসনে টানা নির্বাচিত হয়ে আসছেন করবিন। ২০২০ সালে লেবার পার্টি থেকে করবিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দলে তাঁর নেতৃত্বের সময় ইহুদিবিরোধী অভিযোগগুলো তিনি কীভাবে সামলেছেন এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁকে দল থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় লেবার পার্টি। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার নিন্দা জানিয়ে আসছেন করবিন। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যে একাধিক বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছেন তিনি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির সরকারে সামগ্রিক নীতির বড় সমালোচক করবিন। এমনকি গাজায় ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযোগ তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রতি আহ্বান জানানো রাজনীতিকদের একজন তিনি।এদিকে কঠিন সমীকরণে কনজারভেটিভ দল । এখন পর্যন্ত ৭৮ জন এমপি পদত্যাগ করেছেন। ফলে ৪জুলাই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চরম বেকায়দায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক । এ ঘটনা ২৭ বছর আগে ১৯৯৭ সালে ভরাডুবির আগের চিত্রকেও হার মানিয়েছে । তখন এই ডলের ৭২ জন এমপি পদত্যাগ করেছিলেন। এদিকে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে লেবার পার্টি । বর্তমানে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ঋষি সুনাকের দলের চেয়ে স্যার কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি ২০ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে । প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, এই নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হবে , যখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে সবচেয়ে বিপদজনক অবস্হায় রয়েছে। তিনি এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি তার প্রচারের মূল বিষয় করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে কি কি কর্মকাণ্ড চালাবে এর মধ্যে ফিলিস্তিন একটি রাষ্ট্র হওয়া উচিত কিনা বিবিসির সাংবাদিক এর করা এরকম প্রশ্নের জবাবে স্টারমার বলেন, হ্যাঁ , আমি মনে করি । আমি মনে করি ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরাইলের পাশাপাশি একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রয়োজন । স্বীকৃতি প্রদানটা এই কার্যক্রমের অংশ হতে পারে । বাংলাদেশের ৪জন এমপি বিগত দিনে এই সংসদে বিজয়ী হয়েছিলন একসাথে । তখন থেকে বাঙালি পাড়ায় নির্বাচনের সময় আনন্দ উৎসব শুরু হয়। চলে ক্যাম্পেইন দিনরাত । সবার অপেক্ষা শুরু হয়েছে কবে তাদের পছন্দের প্রার্থীর আবার বিজয় হবে । এ নিয়ে বেশ সরগরম বাঙ্গালীদের শহর বলে খ্যাত বাংলা টাঊন । এই এলাকায় দেখা যাচ্ছে রুশনারা আলীর ক্যাম্পেইন পরিণত হয়েছে মহা উৎসবে । লেবারপার্টির বিপুল সমর্থকদের দখলে থাকা আসন থেকে যদি এই চারজন সংসদ সদস্য পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন এবং লেবার পার্টি ব্রিটেনে ক্ষমতায় আসে, তাহলে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় অন্তত একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্থান পেতে পারেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে মন্ত্রী পদের লড়াইয়ে লেবার পার্টির ভেতরে চারবারের এমপি রোশনারা আলী ও তিনবারের এমপি বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। ইস্ট লন্ডন লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বাউ , পপলার ও লাইমহাউস আসনে লেবার পার্টির মনোনীত প্রার্থীর এমপি হওয়া আরও নিশ্চিত। রুশনারা আলী গত চারটি নির্বাচনে লেবারদের জন্য পূর্ব লন্ডন লন্ডনের সবচেয়ে নিরাপদ ও নিরাপদ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। সিলেটের বিশ্বনাথের ভুরকি গ্রামে জন্ম নেওয়া ৪৯ বছর বয়সী রুশনারা এই আসনে লেবার পার্টির প্রার্থী। তিনি ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডনে চলে আসেন। ইস্ট লন্ডন আসনে গতবার স্থানীয় লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশধরদের বিরোধিতার মুখে লেবার মনোনয়ন ও নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়ী হন অপ্সনা বেগম। গত নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী অপ্সনা প্রায় ২৯,০০০ ভোটে কনজারভেটিভ প্রার্থী শিউন ওককে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ৩৪ বছর বয়সী, উদ্যমী ভদ্রমহিলা টাওয়ার হ্যামলেটসের শ্যাডওয়েলে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন। তার বাবার বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। অপ্সনার বাবা মনির উদ্দিন টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর ছিলেন। তিনি আসন্ন নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী তালিকায় সংক্ষিপ্ত প্রার্থী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসনের তিনবারের এমপি। ৪১ বছর বয়সী টিউলিপকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা লেবার পার্টির মধ্যে নতুন প্রজন্মের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদ হিসাবে মূল্যায়ন করেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে, টিউলিপ প্রথমবারের মতো লেবার পার্টির অ-নিরাপদ আসনে একটি উত্তপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে জয়লাভ করেন । লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় দুবার দায়িত্ব পালন করা টিউলিপ সিদ্দিক আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হলে এবং তার নিজের দল লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভায় তার স্থান হবে বলে অনেকে মনে করছেন । রুপা হক তৃতীয়বারের মতো লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়ে লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল আসনে টানা এমপি হন।
৫২ বছর বয়সী ব্রিটিশ বাংলাদেশি মেয়ে রাজনীতিতে আসার আগে লন্ডনের কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন। কলামিস্ট ও লেখক সর্বশেষ কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে মোহাম্মদ হক ও রওশন আরা হকের তিন কন্যার মধ্যে রূপা হক সবার বড়। তার বাবা-মা ১৯৭০ সালে ব্রিটেনে আসেন। তার বাবার বাড়ি পাবনা শহরের কুঠিপাড়ায়। সহজ-সরল ও বিনয়ী আচরণের জন্য রূপা হক তার নির্বাচনী এলাকার ভেতরে এবং বাইরে বেশ পছন্দের। এবার জনমত জরিপে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন রূপা হক। ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিকরা ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হতে দেখছেন সবাই , ব্রিটেনে বসবাস করছেন প্রায় দেড় মিলিয়ন বাংলাদেশি কিন্তু কোনো বাংলাদেশি এখনও মন্ত্রী হতে পারেননি। এই দেশের বর্তমান অবস্হাদৃষ্টে মনে হচ্ছে লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে এবং লেবার পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বর্তমান চার সংসদ সদস্য পুনরায় নির্বাচিত হয়ে আসেন তবে হয়তো কোন এক নতুন বাঙ্গালি ইতিহাস গড়ার সুযোগ পাবেন । তাই সকল বাংলাদেশিদের যার যার অবস্হান থেকে এই সব বাংলাদেশি প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার সুচিন্তিত মতামত পোষণ করেন সুশীলরা
লেখকঃ ড. আজিজুল আম্বিয়া , কলাম লেখক ও গবেষক । Email: azizul.ambya@yahoo.co.uk