রেমিট্যান্সে বদলাচ্ছে সিলেট, হারাচ্ছে শিকড়

সুবর্ণা হামিদ-
সিলেটকে অনেকে বলে প্রবাসের রাজধানী। ইউরোপের নানা দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত লাখো সিলেটি তাদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠাচ্ছেন এই অঞ্চলে। সেই টাকায় গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, শোরুম, আধুনিক স্কুল। বদলেছে জীবনযাত্রার মান। কিন্তু এই রেমিট্যান্স-নির্ভর জীবনধারায় কি সমাজে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের মূল্যবোধহীনতা? কর্মসংস্থানের পরিবর্তে অলসতা, আত্মনির্ভরশীলতার জায়গায় নির্ভরতা—এটাই কি সিলেটের ভবিষ্যৎ চিত্র?
সিলেটের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসছে এই অঞ্চলে। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, জকিগঞ্জ—প্রায় সব উপজেলাতেই প্রবাসী পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা দেশে বাড়ি বানান, গাড়ি কেনেন, ব্যবসা করেন। ফলে অর্থনৈতিকভাবে সিলেট তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত। শহরে আধুনিক ভবন, বড় বড় শপিংমল, দামি গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।
তবে এই দৃশ্যমান পরিবর্তনের ভেতরে কিছু অদৃশ্য সমস্যা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। অনেক তরুণ নিজেরা কিছু করতে চায় না, শুধু বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ বছরের পর বছর অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করছে, কারণ পরিবার থেকে টাকায় সব কিছু চলে যাচ্ছে। ফলে কর্মসংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও একই চিত্র। অনেকে স্কুল-কলেজে ঠিকমতো যায় না, কারণ তাদের পরিবারে অভাব নেই। তারা মনে করে, পড়াশোনা ছাড়াই জীবনে সফল হওয়া সম্ভব, যদি বিদেশ যাওয়া যায় বা পরিবারের প্রবাসী সদস্য টাকা পাঠাতে থাকে।
এছাড়া পরিবারেও পরিবর্তন এসেছে। বাবারা দীর্ঘদিন বিদেশে, সন্তান বড় হচ্ছে দাদা-দাদির কাছে। মা কখনো একা থাকেন, কখনো তিনিও প্রবাসে। ফলে অনেক পরিবারে ভালোবাসা, শাসন আর মূল্যবোধের জায়গায় তৈরি হচ্ছে শূন্যতা। অনেকে এই বিষয়গুলোকে মনোযোগ দিচ্ছে না, কারণ টাকার জোগান ঠিকই হচ্ছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী নূরজাহান শিল্পী বলেন, প্রবাসের জীবন বাইরে থেকে যতটা ঝলমলে মনে হয়, বাস্তবে তা অনেক কঠিন ও সংগ্রামের। আমরা যারা বিদেশে আছি, তারা প্রতিদিন ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করি। কিন্তু এসব কষ্ট, এই আত্মত্যাগ — দেশের মানুষ অনেক সময় তা বুঝতে পারে না।
আমরা যখন দেশে যাই, নিয়ে যাই বুকভরা আবেগ, ভালোবাসা আর শিকড়ের টান। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় হতাশ করে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যে আন্তরিকতা আশা করি, তা অনেক সময় মেলে না। বরং দেখা যায়, তারা রাগ করে বসে থাকে — আমরা নাকি আগে খোঁজ নিইনি, আগে দেখা করিনি। অথচ কেউ খোঁজ নেয় না আমরা সুস্থভাবে দেশে পৌঁছেছি কি না। মূল্যায়নটা যেন শুধুই স্বার্থের জায়গা থেকে আসে। তবে অবশ্যই সবাই একরকম নয় — এর মাঝেও কিছু ব্যতিক্রম মানুষ আছেন, যাঁরা এখনো হৃদয় দিয়ে আমাদের অনুভব করেন।
আমার চার সন্তান। তারা এখন আর বাংলাদেশে যেতে চায় না। তাদের মাঝে দেশের প্রতি সেই টানটা নেই, যেটা আমাদের মধ্যে ছিল। এটা ভাবলে বুকটা ভার হয়ে আসে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে প্রবাসী প্রজন্মের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যাবে। আর এতে করে দেশের বড় এক শক্তি — রেমিট্যান্স — ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। এটা শুধু আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, অনেক প্রবাসীরই এক নিঃশব্দ যন্ত্রণা।
আরেক প্রবাসী ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশী আব্দুল রহমান বলেন - আমি ১৮ বছর ধরে লন্ডনে বাস করি। শুরুতে রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম, এখন ছোট একটা টেইকঅ্যাওয়ে ব্যবসা আছে। প্রতি মাসেই দেশে টাকা পাঠাই। বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান সবাই থাকে দেশে। বাড়ি বানিয়েছি, দুই ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াই। কিন্তু প্রবাস জীবনটা খুব একটা গ্ল্যামারাস নয়।অনেকেই ভাবে, বিদেশ মানেই টাকা। অথচ প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করি। সেই কষ্টের মূল্য দেশে খুব কম মানুষ বোঝে। আমার ছেলেরা হয়তো সেই টাকা পায়, কিন্তু আমি ওদের পাশে থাকতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, শুধু টাকা পাঠিয়ে কি বাবা হওয়া যায়?
এ ব্যাপারে প্রবাসীর স্ত্রী ছাবিনা আক্তার বলেন - আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকেন, টাকাপয়সা সবই ঠিক মতো পাঠান কিন্তু আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে সরাসরি ভালো করে দেখে নি। বাচ্চাদের ছোট রেখে তিনি বিদেশে যান কিন্তু এখন নানা জটিলতার কারণে দেশে আসতে পারছেন না। এই দিকে তাদের বাবা না থাকায় আমাকে একা একা মা বাবা দুইজনের দ্বায়িত্ব পালন করছি। ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি। কিন্তু একা সংসার চালানো সহজ নয়। বিশেষ করে সন্তানদের মানুষ করাটা খুব কঠিন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন—প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থে বদলে যাচ্ছে সিলেট- বাড়ছে জীবনমান, গড়ে উঠছে আধুনিক স্থাপনা। কিন্তু আমরা যদি তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে না আনতে পারি, তাহলে এই প্রাচুর্য সমাজে নৈতিক দারিদ্র্য তৈরি করবে—এটাই সবচেয়ে বড় আশঙ্কা।
রেমিট্যান্স আমাদের অঞ্চলকে এগিয়ে দিচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে একটি ভয়ংকর 'নির্ভরশীলতা' গড়ে উঠছে। অনেক পরিবারে বাবা-মা প্রবাসে, সন্তান বড় হচ্ছে দাদা-দাদির কাছে—যেখানে অভিভাবকত্বের শূন্যতা শিশুদের মানসিক গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তরুণদের মধ্যে একধরনের বিভ্রান্তি কাজ করছে—তারা মনে করে, পড়াশোনার প্রয়োজন নেই; শুধু বিদেশ গেলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই মানসিকতা থেকে জন্ম নিচ্ছে দায়িত্বহীনতা, পরিশ্রমের অবমূল্যায়ন, এমনকি আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি। তারা নিজেদের গড়তে চায় না, শুধু ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে মগ্ন থাকে।
গোলাপগঞ্জের এক কলেজ শিক্ষার্থীর ভাষায়, আমার ভাই লন্ডনে। আমিও যাব। আপাতত কিছু করি না ।এ কথা বলার সময় তার চোখে কোনো সংকোচ নেই—বরং আত্মবিশ্বাস।
পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে। অনেকেই বিদ্যালয়ে ঠিকমতো যায় না। তাদের বিশ্বাস, বিদেশে যাওয়ার পরই জীবনের ‘মূল সময়’ শুরু হবে। ফলে দেশেই থাকা অবস্থায় শিক্ষা, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা অর্জনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
শুধু তরুণরাই নয়, প্রবাসে থাকা পরিবারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা। বাবা-মা বিদেশে, সন্তান